(নিউ ইয়র্ক) – ২০২৫ সালের মে মাস থেকে ভারত সরকার কোনো ধরনের অধিকার বিষয়ক সুরক্ষা না দিয়েই বহু সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে ও মিয়ানমারে বহিষ্কার করেছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ জানায় যে। কর্তৃপক্ষ আরও কয়েকশ রোহিঙ্গাকে নির্বিচারে আটক করে এবং তাদের কয়েকজনের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছে।
মে মাসে, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার দ্বারা পরিচালিত রাজ্যগুলো রোহিঙ্গা এবং বাংলাভাষী মুসলিমদেরকে “অবৈধ অভিবাসী” হিসেবে বহিষ্কার করার জন্য একটি অভিযান শুরু করে। বহিষ্কৃতদের মধ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এর সাথে নিবন্ধিত কমপক্ষে ১৯২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কর্তৃপক্ষ মিয়ানমার উপকূলের কাছে একটি জাহাজে ৪০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তুলে দেয় এবং তাদের সাঁতার কেটে তীরে আসতে বাধ্য করে। এই অভিযান এড়ানোর জন্য আরও বহু সংখ্যক শরণার্থী বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে।
“রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারতের সরকার কর্তৃক বহিষ্কার মানবজীবন ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে,” হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন। “মিয়ানমারে অত্যাচার ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা এই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো শাসক দল বিজেপির মুসলিমদের ‘অবৈধ’ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করার নীতির প্রতিফলনকে প্রকাশ করে।“
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে সম্প্রতি ভারত থেকে আসা ৯ জন রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। মে মাসে বহিষ্কৃত হওয়া ৬ জন অভিযোগ করেছে যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের মারধর করে এবং তাদের টাকা, মোবাইল ফোন ও ইউএনএইচসিআর রেজিস্ট্রেশন কার্ড কেড়ে নেয়। পুলিশ তাদের নির্বিচারে আটকের হুমকি দেওয়ার পর, জম্মু ও কাশ্মীর, অন্ধ্র প্রদেশ এবং দিল্লি থেকে অন্য তিনজন বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
আনুমানিক ৪০,০০০ রোহিঙ্গা ভারতে বসবাস করে, যাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০,০০০ জন জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে নিবন্ধিত। যদিও ভারত ১৯৫১ সালের জাতিসংঘ শরণার্থী কনভেনশন বা তার ১৯৬৭ সালের প্রটোকলের অংশ নয়, তবে ভারত আন্তর্জাতিক আইনের ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ (nonrefoulement) নীতির দ্বারা আবদ্ধ, যা কোনো দেশকে এমন স্থানে মানুষ ফেরত বা বহিষ্কার করতে নিষেধ করে যেখানে তাদের জীবন বা স্বাধীনতার জন্য হুমকি রয়েছে।
ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার একটি আটক কেন্দ্রে আটক থাকা ৩৭ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী বলেন যে, ৬ মে রাতে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কর্মকর্তারা বন্দুকের মুখে তাকে, তার স্বামী এবং তাদের তিন সন্তানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়। “আমার স্বামী যখন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করে যে আমাদের কোথায় যাওয়া উচিত, কারণ আমাদের কাছে কোনো টাকা নেই এবং আমরা এই এলাকা চিনি না, তখন তারা আমাদের বাধ্য করে। তারা তাকে এমন জোরে থাপ্পড় মারে যে সে এখনও ঠিকভাবে শুনতে পায় না,” তিনি বলেন। “তারা আমাদের আরও কথা বললে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।”
এই পরিবার ২০১২ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নির্মূলকরণ অভিযান থেকে বাঁচতে পালিয়েছিল, কিন্তু আসামের কারাগারে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আটক ছিল।
৬ই মে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের অজুহাতে দিল্লিতে ১৩ জন নারী সহ ৪০ জন মুসলিম এবং খ্রিষ্টান রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নির্বিচারে আটক করে। কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে বিমানে করে নিয়ে যায় এবং সেখানে একটি ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজে উঠতে বাধ্য করে, যা পরে যাত্রা শুরু করে। জাহাজের কর্মীরা তাদের মারধর করে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। দিল্লিতে থাকা একজন রোহিঙ্গা খ্রিষ্টান ব্যক্তি, যার ভাই বহিষ্কৃতদের মধ্যে ছিল, তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন যে, জাহাজটি মিয়ানমার উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছালে কর্মীরা শরণার্থীদের লাইফ জ্যাকেট দেয় এবং তারপর তাদের সমুদ্রে ফেলে দেয়।
শরণার্থীরা সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছায় এবং মিয়ানমারের তানিন্থারি অঞ্চলের লাউংলং টাউনশিপে এসে পৌঁছায়। একজন জেলেদের ফোন ব্যবহার করে পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করে। “আমাদের সবচেয়ে খারাপ অপরাধীর মতো আচরণ করা হয়েছিল,” তিনি একজন আত্মীয়কে বলেন। “একজন অফিসার বলেছিলেন, ‘কেউ আপনাদের জন্য কথা বলবে না। আমরা যদি আপনাদের সবাইকে মেরেও ফেলি, তবে কেউ আমাদের জবাবদিহি করবে না।’ আমাদের মধ্যে কিছু মানুষ সাঁতার জানতো এবং যারা পারছিল না তাদের তীরে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল।” মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুস বলেন, এই ঘটনাটি “আন্তর্জাতিক সুরক্ষা প্রয়োজন এমন মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে।“
নির্বিচারে আটকের ভয়ে কিছু রোহিঙ্গা পরিবার ভারত থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জানায় যে, পুলিশ পালিয়ে আসা মানুষদের মারধর করে এবং তাদের সঙ্গে সহিংস দুর্ব্যবহার করে। ৪০ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা ব্যক্তি, যিনি ইউএনএইচসিআর- এর নিবন্ধিত শরণার্থী এবং হায়দ্রাবাদে থাকতেন, তিনি ১৫ মে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে একটি রোহিঙ্গা দলের সাথে ট্রেনে করে যাত্রা শুরু করেন। তবে, পুলিশ ত্রিপুরা রাজ্যের একটি রেলওয়ে স্টেশনে দলটিকে আটক করে, তাদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য তথ্য নেয় এবং তারপর তাদের মারধর করে। “তারা এমনকি আমার ৪ বছর বয়সী মেয়েকেও মেরেছে,” তিনি বলেন। “তারা মহিলাদেরও অপমান করেছে। তারা আমাদের ফোন এবং আমার ২০,০০০ ভারতীয় রুপি [২৩০ মার্কিন ডলার] নিয়ে নিয়েছে। তারা সবকিছু নিয়ে গেছে, এমনকি আমার সন্তানের ব্যবহার করা একটি স্কুল ব্যাগও।”
ওই ব্যক্তি বলেন যে, পুলিশ তাদের সীমান্ত কর্মকর্তাদের কাছে হস্তান্তর করে, যারা লাঠি দিয়ে দলের পুরুষদের মারধর করে, একটি ভিডিও বানাতে বাধ্য করে এবং তারপর তাদের জোর করে বাংলাদেশের সীমান্তে পাঠিয়ে দেয়। “তারা আমাদের বলতে বাধ্য করে যে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আর আমরা ভারতে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিলাম এবং ভারত সরকার আমাদের আটক করে ফিরিয়ে দিচ্ছে,” তিনি বলেন, “তারা আমাদের বলে যে যদি বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা আমাদের ভারতে ফেরত পাঠায়, তবে আমাদের গুলি করা হবে।”
মার্চ মাসে, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ভারতীয় সরকারকে চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা সহ শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের নির্বিচারে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য আটক করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আটক কেন্দ্রগুলোর পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন, যার মধ্যে খারাপ ব্যবহার ও মারধর, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা না পাওয়া, আটক অবস্থায় মৃত্যু এবং দেশ থেকে বিতাড়নের অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এর আগে ভারতে কিছু পরিমাণে শিক্ষা ও জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেত, কিন্তু ২০১৭ সালে সেই নীতি পরিবর্তিত হয় যখন বিজেপি সরকার “অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের, যার মধ্যে রোহিঙ্গারাও অন্তর্ভুক্ত, বহিষ্কার করার জন্য বিস্তারিত নির্দেশাবলী জারি করে।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায় যে, এই বহিষ্কারের কারণে ভারতে রয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এখন খুবই অনিরাপদ বোধ করছে। মে মাসে জম্মুতে, কর্তৃপক্ষ শরণার্থী শিবিরগুলোতে ভাঙচুর করে এবং কমপক্ষে ৩০ জন শরণার্থীকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে, বলেন ৪০ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা নারী যিনি পুলিশি হুমকির পর সেই মাসেই তার দুই সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। “তারা আমাদের ইউএনএইচসিআর কার্ড এবং মিয়ানমারের জাতীয়তার নথি উভয়ই উপেক্ষা করে আমাদের ‘বাঙালি’ বলে অভিযুক্ত করে।”
২৯ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা পুরুষ যাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা ২০ জুন জোর করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল, তিনি বলেন: “এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে, আমরা পালিয়ে বেড়াচ্ছি এবং এমন একটি আশার সন্ধান করছি যা কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেছে যে তারা সিদ্ধান্ত নেবে যে রোহিঙ্গারা “শরণার্থী” নাকি “অবৈধ প্রবেশকারী” এবং তারা কী ধরনের অধিকার ও সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী। পরবর্তী শুনানি ২৩ সেপ্টেম্বর নির্ধারিত রয়েছে। মে মাসে, আদালত দেশ থেকে বিতাড়ন বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং সমুদ্রে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পরিত্যাগ করার ঘটনাটিকে “সুন্দরভাবে সাজানো গল্প” বলে খারিজ করে দেয়।
“ভারত সরকারের অবিলম্বে সকল রোহিঙ্গা শরণার্থীর উপর থেকে ভয়ভীতি, নির্বিচারে আটক ও অবৈধ বহিষ্কার বন্ধ করা উচিত এবং তাদের প্রতি খারাপ আচরণের অভিযোগগুলো নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা উচিত,” পিয়ারসন বলেন। “ভারতীয় কর্তৃপক্ষের উচিত রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং তাদের অধিকার সুরক্ষায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে কাজ করা।”