Skip to main content

বাংলাদেশ : বাল্য বিবাহে ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েরা

বিয়ের বয়স ১৬-তে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা বন্ধ করুন

(ঢাকা)-বাংলাদেশ সরকার বাল্য বিবাহ বন্ধে অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও এখনও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি, আজ প্রকাশিত নতুন এক প্রতিবেদনে এই কথা জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷ ২০১৪ সালের জুলাইয়ে, ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্য বিবাহ পুরোপুুুরি বন্ধ করার কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ কিন্তু তারপরই তিনি মেয়েদের বিয়ের নূ্যনতম বয়স ১৮ থেকে ১৬-তে নামিয়ে আনার ভুল পদক্ষেপ নিয়েছেন, যা কি না এ ব্যাপারে তার অঙ্গীকার নিয়ে গুরুতর সংশয় জাগাচ্ছে৷
ইউনিসেফের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ১৫ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বাল্য বিবাহের হার সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ৷ বাংলাদেশে শতকরা ২৯ ভাগ মেয়েরই বিয়ে হয় ১৫ বছরের কম বয়সে৷ এর মধ্যে শতকরা দুই ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১১ বছরের কম বয়সে৷ সরকারের ক্রমাগত নিষ্ক্রিয়তা এবং স্থানীয় কর্মকর্তাদের সহযোগিতার ফলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাল্য বিবাহ সম্পন্ন, এমনকি খুব অল্প বয়সে তা হচ্ছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপক প্রবণতাও অনেক মেয়েকে এর ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে৷ এসব দুর্যোগ তাদের পরিবারকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যা পরিবাগুলোকে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত
নিতে বাধ্য করছে৷
"বাল্য বিবাহ বাংলাদেশে এক মহামারী হয়ে উঠেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যা শুধু আরও খারাপের দিকে যায়"-বলেছেন নারী অধিকার বিষয়ক সিনিয়র গবেষক হিদার বার৷ তিনি আরও যোগ করেন-"বাংলাদেশ সরকার কিছু ঠিক কথা বলেছে, কিন্তু মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে আনার যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা ভুল বার্তা দিচ্ছে৷ সরকারের উচিত মেয়েদের আরও একটি প্রজন্ম হারিয়ে যাওয়ার আগেই সক্রিয় হওয়া৷"
"বিয়ে কর তোমার ঘর-বাড়ি ভেসে যাওয়ার আগেই : বাংলাদেশে বাল্য বিবাহ"-১৩৪ পাতার এই প্রতিবেদনটি দেশজুড়ে করা শতাধিক সাক্ষাত্‍কারের ভিত্তিতে তৈরি৷ এদের অধিকাংশই বিবাহিত নারী, কারো কারো বয়স মাত্র ১০৷ এটি মানুষকে বাল্য বিবাহের দিকে ঠেলে দেওয়ার কারণগুলো তুলে ধরেছে, যার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শিক্ষায় অধিকারের অভাব, সামাজিক চাপ, হয়রানি ও যৌতুক৷ বাল্য বিবাহ বাংলাদেশে একটি মেয়ে ও তার পরিবারের কী ধরনের ক্ষতি করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে৷ যেমন মাধ্যমিক পর্যায়েই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া, গুরুতর স্বাস্থ্যগত সমস্যা, আগাম গর্ভধারণের ফলে যা মৃতু্য পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে, স্বামী পরিত্যক্ত হওয়া এবং স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের হাতে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়া৷
বাল্য বিবাহ বাংলাদেশে ১৯২৯ সাল থেকে অবৈধ৷ ১৯৮০ সালে বিয়ের নূ্যনতম বয়স মেয়েদের ১৮, ছেলেদের ২১ নির্ধারণ করা হয়েছে৷ তা সত্ত্বেও বাংলাদেশে ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়েদের বিয়ের হার বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ৷ এ ক্ষেত্রে নাইজার, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ও চাদ-এর পরই বাংলাদেশের অবস্থান৷ বাংলাদেশে শতকরা ৬৫ ভাগ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর বয়সের আগেই৷
বিদ্যমান আইন প্রয়োগ ও বাল্য বিবাহের যেসব কারণ রয়েছে সেগুলো মোকাবেলায় সরকারের ব্যর্থতায়, গরিব পরিবারগুলো নিম্নোক্ত সমস্যায় বাল্য বিবাহকেই উপযুক্ত সমাধান মনে
করে আসছে-
ঙ্ যেসব বাবা-মা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারে না, তাদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পাওে, না তারা মেয়ের জন্য একটা বর খুঁজে নিতে চাইতে পারে যাতে মেয়েটা অন্তত: খেতে পায়৷
ঙ্ শিক্ষা ুঅবৈতনিকচ্ হওয়া সত্ত্বেও অনেক গরিব মেয়ে স্কুলে যেতে পারে না, কারণ তাদের পরিবার পরীক্ষার ফী, স্কুল পোশাক, খাতা-কলমসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ জোগাতে পারে না৷
ঙ্ যেসব মেয়ে স্কুল ছেড়ে যায়, বাবা-মা প্রায়ই তাদের বিয়ে দিয়ে দেন৷
ঙ্ অবিবাহিত মেয়েদের যৌন হয়রানি এবং তা ঠেকাতে পুলিশের ব্যর্থতাও বাল্য বিবাহকে ত্বরান্বিত করে৷
ঙ্ সামাজিক চাপ ও রীতিনীতি, যৌতুক দেওয়ার ব্যাপক প্রচলন, যত কমবয়সী মেয়ে তত কম যৌতুক-এই ধারণা বাল্য বিবাহকে অনেক সম্প্রদায়ের কাছে শুধু গ্রহণযোগ্যই করে রাখে না, প্রত্যাশিতও করে তোলে৷


এই প্রতিবেদনে আরও যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হল বাল্য বিবাহে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভূমিকা৷ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত ও জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ৷ এসব দুর্যোগ অনেক পরিবারকেই গভীর দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়, যা তাদের মেয়েদের শিশু বয়সে বিয়ের ঝুঁকি বাড়ায়৷ পরিবারগুলো জানিয়েছে-এসব দুর্যোগের পর অথবা তা আগাম অনুমান করেই তারা অল্পবয়সী মেয়েদের দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করার চাপ অনুভব করেন৷ বিশেষ করে নদীভাঙনে ক্রমাগত ধ্বংসযজ্ঞের ফলে যারা ঘর-বাড়ি, জমিজমা হারান তাদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যায়৷
বাংলাদেশ সরকার বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে৷ ২০১৪ সালে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক "কন্যা-শিশু সম্মেলনে"- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বাল্য বিবাহ বন্ধের অঙ্গীকার করেছিলেন৷ তিনি কতগুলো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে ২০১৪ সালের মধ্যেই আইনের সংস্কার ও একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন৷ এর কোনোটিই অর্জিত হয়নি৷ আরও বাজে ব্যাপার হচ্ছে-বাংলাদেশ সরকার উল্টো মেয়েদের বিয়ের নূ্যনতম বয়স ১৮ থেকে ১৬-তে নামিয়ে আনার ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে৷
স্থানীয় সরকারের অনেক কর্মকর্তার কারণেও বাল্য বিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েরা নিজেদের রক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছে৷ বাংলাদেশের আইনে যে ১৮ বছরের কমবয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়া অবৈধ এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ছে৷ কিন্তু বাল্য বিবাহে ব্যাপক সহযোগিতা দিয়ে স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা এই সচেতনতাকে মারাত্মকভাবে অবমূল্যায়ন করছেন৷ সাক্ষাত্‍কারদাতারা বারবার জানিয়েছেন-স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তারা মাত্র ১০০ টাকা ঘুষের বিনিমেয়ে ভুয়া জন্ম সনদ দিয়ে মেয়েদের বয়স
১৮-এর বেশি দেখিয়েছেন৷ এমনকি স্থানীয় কর্মকর্তারা যদি বিয়ে ঠেকিয়েও দেন, যা তারা মাঝে মধ্যে করে থাকেন, পরিবারের সদস্যরা অন্য কাউকে দিয়ে সহজেই বিয়ের কাজটি
সেরে নিতে পারেন৷
"বাল্য বিবাহ বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসমক্ষে যে অঙ্গীকার করেছেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত তা নিয়ে দৃঢ়ভাবে এবং দ্রুত কাজ করা"-বলেছেন বার৷ "প্রথম পদক্ষেপই হওয়া উচিত অনতিবিলম্বে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৬-তে নামিয়ে আনার প্রস্তাব থেকে পিছিয়ে আসা"-তিনি আরও যোগ করেন৷
অন্য অনেক ক্ষেত্রেই উন্নয়নের সফল উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা হয়৷ এর মধ্যে রয়েছে নারীর অধিকারও৷ বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ১৯৯১-৯২ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ৫৬.৭ শতাংশ থেকে ৩১.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার বিয়টি জাতিসংঘকে 'চমত্‍কৃত' করেছে৷ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লৈঙ্গিক সমতা অর্জন করেছে৷ মাতৃমৃতু্য ২০০১ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ৪০ ভাগ কমে এসেছে দেশটিতে৷ নানা বিষয়ে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্যে এ প্রশ্নটি আরও বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে যে-তাহলে এখানে কেন এখনও বাল্য বিবাহের হার উচ্চমাত্রায় রয়ে গেছে, যা কি না বিশ্বে অন্যতম নিকৃষ্ট৷
অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ ও শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে৷ এসব অধিকারের মধ্যে রয়েছে মানসম্মত স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বৈষম্যমুক্ত থাকার অধিকার, বিয়েতে স্বাধীন ও পূর্ণ মতামত দেওয়ার অধিকার, দাম্পত্য সঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকার, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনমুক্ত থাকার অধিকার৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দেখেছে, বাল্য বিবাহের ফলে এসব অধিকারের বাস্তবায়ন ও সুরক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যেতে পারে৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের গ্রাম পর্যায়ে গবেষণায় বাল্য বিবাহ সম্পর্কিত আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সহায়তা প্রকল্পগুলোয় গলদ, যা বাল্য বিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের জন্য আরও অনেক কিছু করতে পারত-সে চিত্র তুলে ধরেছে৷ প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা অবৈতনিক করার মধ্য দিয়ে শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বাড়াতে সরকার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে৷ কিন্তু স্কুলে যাওয়ার আনুষঙ্গিক আরও অনেক খরচের কারণে শিক্ষা, বিশেষত: মাধ্যমিক শিক্ষা এখনও অনেক শিশুর সাধ্যের বাইওে রয়েছে৷ মেয়েদের বেলায় প্রায়ই এর পরিণতি হচ্ছে বাল্য বিবাহ৷ যেসব সরকারি সংস্থা দরিদ্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিচ্ছে তাদের বাল্য বিবাহ বন্ধে আরও দক্ষ হতে হবে৷ প্রজনন স্বাস্থ্য ও জন্ম নিরোধক সামগ্রী কোথায় সরবরাহ করা হয় সে সম্পর্কিত তথ্য অনেক মেয়ের কাছেই নেই যাদের কি না এটি সবচেয়ে বেশি দরকার৷ সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার এমন মেয়েদের মধ্যে আমরা যাদের সাক্ষাত্‍কার নিয়েছি প্রায়ই দেখা গিয়েছে যে, তাদের সাহায্যের জন্য কোথাও যাওয়ার উপায় নেই৷ বাল্য বিবাহ সম্পর্কিত বাংলাদেশের আইনটির সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এটি পরিপূর্ণভাবে
কার্যকর করা প্রয়োজন৷
"অল্পবয়সী মেয়েরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ৷ বাল্য বিবাহ সম্পর্কে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা তাদের ভয়াবহ ক্ষতি করছে"-বলেন বার৷ তিনি আরও বলেন, "মেয়েদের স্কুলে ধরে রাখা, বাল্য বিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের সহায়তা করা, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে লড়াই, প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ও জন্ম নিরোধক সামগ্রী পাওয়া -এসব ব্যাপারে সরকার ও তার দাতাগোষ্ঠীর আরও অনেক কিছু করা উচিত৷ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকারের উচিত বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে তার নিজের আইনটি প্রয়োগ করা৷"

GIVING TUESDAY MATCH EXTENDED:

Did you miss Giving Tuesday? Our special 3X match has been EXTENDED through Friday at midnight. Your gift will now go three times further to help HRW investigate violations, expose what's happening on the ground and push for change.
Region / Country