সারাংশ
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের স্বীকৃতিদানে এবং সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নকালে হিজড়ারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
২০১৪ সালের ২৬শে জানুয়ারী, বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা সরকারী ইশতেহারে তৃতীয় লিঙ্গকে এই বলে স্বীকৃতিপ্রদান ও তালিকাভুক্ত করে যে: "বাংলাদেশ সরকার হিজড়া সম্প্রদায়কে হিজড়া লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।" এই ঘোষণা বাংলাদেশের হিজড়া সম্প্রদায়ের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি সম্প্রদায়, যাদের জন্মের সময় পুরুষ এবং জীবনের পরবর্তী সময়ে মহিলা পরিচয়ে চিহ্নিত করা হয়, তারা নিজেদের হিজড়া অথবা একটি তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ পরবর্তীতে তার তাৎপর্য হারিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ সরকারের কোনো নির্ধারিত নীতিমালা নেই যেখানে একজন ব্যাক্তিকে আইনগতভাবে "পুরুষ" থেকে "হিজড়া" লিঙ্গে পরিণত করার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, এবং কাদের হিজড়া হিসেবে গণ্য করা হবে সে বিষয়েও কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে, সরকারী কর্মকর্তারা এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে হিজড়া সম্পর্কে তাদের নিজেদের পূর্বধারণার সাহায্য নিয়েছেন।
এই রিপোর্ট বাংলাদেশ সরকারের "হিজড়া" জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান কর্মসূচির প্রথম প্রচেষ্টা বাস্তবায়নের ক্ষতিকর, অনিচ্ছাকৃত কিন্তু ধ্বংসাত্মক পরিণতি এবং অধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরেছে।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় হিজড়াদের সরকারী চাকরীর জন্য আবেদন করতে আমন্ত্রণ জানায়-যা এ সম্প্রদায়ের জন্য একটি বিরাট ব্যাপার যেখানে তারা ভিক্ষাবৃত্তি, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান-বাজনা, যৌনকর্মের মাধ্যমে জীবনযাপন করত এবং যারা সুরক্ষার জন্য হিজড়া দলনেতার ( অথবা "গুরু") উপর নির্ভরশীল ছিল।
প্রথমে এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানাতে, হিজড়ারা সরকারী চাকরীর খোঁজে প্রাথমিক সাক্ষাতকারে অংশগ্রহণ করে। শুরু থেকেই এ প্রকল্প ভাল ভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল না। আবেদনকারীরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে ডিসেম্বর, ২০১৪ সালে প্রাথমিক সাক্ষাতকারের সময়ে তারা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভ্রান্ত-ধারণার কারনে অপমানিত বোধ করেছেন।
অনেকেই বলেছেন যে তারা হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং তাদের লিঙ্গ পরিচয় ও যৌনতা সম্পর্কে অবান্তর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল।
এ অভিজ্ঞতার কারনে পরবর্তী ধাপের জন্য, কিছু আবেদনকারী চাকরীতে নির্বাচিত হবার আশায়। তাদের বেশভূষার পরিবর্তন করে নিজেদের পুরুষ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন, চাকরীতে নির্বাচিত হবার আশায়। তুরভি এ.,একজন হিজড়া যিনি নারীর বেশে তার দৈনন্দিন জীবন কাটান, বলেন, "[সরকারী কর্মকর্তারা] বলেছেন যে অন্যরা আমাকে দেখে ভয় পাবে, তাই আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি। সবকিছু করেছি চাকরী পাবার আশায়।" তার ইন্টারভিউ এরপর তিনি শারীরিক পরীক্ষার জন্য পুরুষের বেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন।
তারপর ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি স্মারকলিপির মাধ্যমে অনুরোধ করে যে "প্রকৃত হিজড়া সনাক্তকরণের যথাযথ পদক্ষেপ হিসেবে সবার শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন করা হবে।" এবং জুন, ২০১৫ সালে, ১২ জন হিজড়া যাদের প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে, তাদের একটি সরকারি হাসপাতালে শারীরিক পরীক্ষা সম্পন্ন করার নির্দেশ দেয়া হয়।
এই তথাকথিত "পরীক্ষা" কালে, চিকিৎসকেরা হাসপাতালের কর্মচারী যেমনঃ মেথরদের হিজড়াদের যৌনাঙ্গ ধরতে বলেন এবং তা দেখে হাসপাতালের অন্যান্য কর্মচারী ও রোগীরা ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করেন- কোনো কোনো সময় এ পরীক্ষা করা হতো ব্যক্তিগত কক্ষে, অথবা সবার সামনে। হাসপাতালের কর্মী, কিছু হিজড়াদের অতিরিক্ত পরীক্ষা করার জন্য একাধিক বার আসার নির্দেশ দেন, অতিরিক্ত পরীক্ষা করার এ কাজটি আরোও কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে।
হাসপাতালে এ লাঞ্ছনার পর, ১২ জন হিজড়াদের ছবি অনলাইন ও প্রচার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তারা দাবী করে যে হিজড়ারা "আসলে পুরুষ" এবং তারা সরকারী চাকরী পাবার জন্যে প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে। কিছু হিজড়া জানিয়েছেন যে ছবিগুলো প্রকাশ করার পর তাদের প্রতি হয়রানির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে- তারা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে- এমনকি তারা তাদের পূর্ববর্তী কর্মসংস্থান হারিয়েছে। এ ছবিগুলো প্রকাশের পর মক্কেলের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তি ও যৌনকর্মে নিযুক্ত হিজড়াদের রোজগারের পথ বন্ধ হয় যায়।
বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের স্বীকৃতিপ্রদানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, কিন্তু উপরোক্ত ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে জরুরিভিত্তিতে একটি সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তা না হলে, হিজড়ারা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হবে।
কর্মপন্থা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অক্টোবর, ২০১৫ থেকে এপ্রিল, ২০১৬ এর মধ্যে ঢাকায়, বিশদ সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে এ রিপোর্টটি তৈরি করেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অক্টোবর, ২০১৫ সালে আটজন হিজড়ার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে যারা বাংলাদেশের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দ্বারা আয়োজিত কর্মসংস্থান কর্মসূচি ২০১৪-২০১৫ তে অংশ নিয়েছিল, সেইসাথে সাক্ষাৎকার নিয়েছে সমাজকর্মী ও বিশেষজ্ঞদের যারা মূলত হিজড়াদের সাথে কাজ করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ , এপ্রিল, ২০১৬ সালে কয়েকজন সমাজকর্মী ও বিশেষজ্ঞ ছাড়াও আরোও ছয়জন হিজড়া যারা এ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল না, তাদের সাথে সাক্ষাৎকারের আয়োজন করে। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা যারা হিজড়াদের সাথে কাজ করে, তাদেরও সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয় যদিও তা এ রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়নি।
সকল সাক্ষাৎকার, আলোচনার বিষয়বস্তু ও চুক্তির জন্য সম্মতি গ্রহণ করা হয়েছে এবং সাক্ষাৎকার প্রদানকারীদের জানান হয়েছে যে কোথায় এবং কিভাবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ তথ্যগুলো প্রচার ও প্রকাশ করবে। সাক্ষাৎকার প্রদানকারীরা আতঙ্কে ছিল যে তাদের অভিজ্ঞতা এবং তথ্যগুলো প্রকাশের জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হবে, তাদের পরিচয় গোপন রাখার জন্য আমরা ছদ্মনাম ব্যবহার করেছি। তাদের সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য কোনো পারিশ্রমিক দেয়া হয়নি, কিন্তু তাদের আসা-যাওয়ার খরচের জন্য একটি ভাতা প্রদান করা হয়েছে।
কিছু সাক্ষাৎকার ইংরেজি দোভাষীর সাহায্যে বাংলায় গ্রহণ করা হয় এবং পরবর্তীতে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। আমাদের সাক্ষাৎকার পর্বটি একজন বাংলাভাষী বিশেষজ্ঞের দ্বারা পরিচালিত হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পহেলা আগস্ট, ২০১৬ সালে এই প্রতিবেদনের উল্লেখিত প্রমাণসহ একটি চিঠি পাঠায়, এ প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো উত্তর পাইনি। এই রিপোর্টের একটি সংস্করণ ১৮ ই আগস্ট, ২০১৬ তে জাতিসংঘের নির্যাতন বিভাগের বিশেষ দূত, এবং সর্বোচ্চ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ দূতের কাছে জমা দেয়া হয়।
হিজড়া |
দক্ষিণ এশিয়ায়, "হিজড়া" শব্দটি একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্ধারণ করে যেখানে জন্মের সময় তাদের পুরুষ হিসেবে গণ্য করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে তাদের মাঝে নারী বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। |
লিঙ্গ |
সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক (প্রাকৃতিকভাবে/জন্মের সময় লিঙ্গ নির্ধারণের বিপরীত) মানদণ্ড যেখানে একটি সমাজ নির্ধারণ করে "পুরুষালী" এবং "মেয়েলী" বৈশিষ্ট্য। |
লিঙ্গ পরিচয় |
একজন ব্যাক্তির অভ্যন্তরীণ, গভীর অনুভূতি যেখানে নিজেকে পুরুষ অথবা মহিলা, উভয় কিংবা পুরুষ মহিলার ঊর্ধ্বে অন্যকিছু মনে করা, যার সাথে জন্মের সময়ে নির্ধারিত লিঙ্গের সামঞ্জস্য থাকা জরুরি নয়। |
উভয়লিঙ্গ |
একজন ব্যাক্তির এমন একটি যৌন ও প্রজনন অঙ্গের সাথে জন্মগ্রহণ করা যা আমাদের চিরাচরিত "পুরুষ" অথবা "মহিলার" সংজ্ঞার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। |
লিঙ্গ পরিবর্তন অস্ত্রোপচার |
অস্ত্রপোচারের মাধ্যমে একজন ব্যাক্তির শারীরিক পরিবর্তন সাধন করা যা তার অনুভূত লিঙ্গ পরিচয়ের প্রতিফলক। এই অস্ত্রপাচার কিছু মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয়: যদিও সব মানুষ রূপান্তরের অংশ হিসেবে অস্ত্রপোচারের মাধ্যমে শারীরিক পরিবর্তন আনেনা; তা নির্ভর করে তাদের চাহিদা, প্রয়োজন এবংসামর্থ্যের উপর। |
হিজড়া |
এক জনগোষ্ঠী যাদের জন্মের সময়ে নির্ধারিত লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে জীবনযাপন পদ্ধতি সামঞ্জস্যপূর্ন নয় (এ জনগোষ্ঠী নিজেদের চিরাচরিত লিঙ্গের চেয়ে ভিন্ন কিছু ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে)। একজন হিজড়া সাধারণত নিজ আগ্রহে পছন্দের লিঙ্গ পরিচয় এবং এ জীবনযাপন পদ্ধতি বেছে নেয়, কিন্তু তারা তাদের পছন্দের লিঙ্গ পরিচয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্থায়ীভাবে শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করতে পারে অথবা পারেনা। |
হিজড়াভীতি |
নেতিবাচক ধারণার উপর ভিত্তি করে হিজড়াদের ভয়, অবমাননা এবং তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করা। |
পটভূমি
দক্ষিণ এশিয়ায়, "হিজড়া" শব্দটি একটি জনগোষ্ঠীর পরিচয় নির্ধারণ করে যেখানে জন্মের সময় তাদের পুরুষ হিসেবে গণ্য করা হয় কিন্তু পরবর্তীতে তাদের মাঝে নারী বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকটভাবে প্রকাশ পায়। হিজড়ারা দক্ষিণ এশীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ এবং গত একদশকে নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং সেইসাথে বাংলাদেশে তাদের আইনগত মর্যাদা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
হিজড়ারা একটি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে বিরাজ করছে- একদিকে তারা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ যা তাদের সমাজিক মর্যাদা, সম্মান এবং এখন আইনগতভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। অন্যদিকে, তারা সীমিত অর্থনৈতিক সুযোগ সম্পন্ন একটি স্তরভিত্তিক সম্প্রদায়ে বাস করে, যেখানে তারা সুরক্ষার জন্য "গুরুর" উপর নির্ভরশীল।[1]
হিজড়ারা ঐতিহ্যগতভাবে আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে বিবাহ ও জন্ম অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ দেবার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে এবং ভিক্ষাবৃত্তি, দোকানের মালিক ও যৌনকর্মের থেকে পয়সা উপার্জন করাও তাদের জীবিকার অংশ। শেষের জীবিকা অর্জনের পথদুটি তাদের সামাজিক অবস্থান বর্ণনা ও বুঝতে সাহায্য করে।
একজন বিশেষজ্ঞ যিনি হিজড়াদের সাথে কাজ করেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে হিজড়ারা মূলধারার সমাজে অংশগ্রহনের সুযোগের অভাবে তাদের নিজস্ব রীতিনীতি ও বেঁচে থাকার পদ্ধতি তৈরি করেছে: "হিজড়ারা নিপীড়িত ও সমাজ থেকে বঞ্চিত এবং বিশ্বাস করে যে, "সমাজ আমাকে মানুষ হিসেবে ভাবে না। তাই আমি কেন সামাজিক রীতিনীতি অথবা সমাজ আমার সম্পর্কে কি ভাবে তার পরোয়া করব? আমি আমার মত করে বাঁচবো।"[2] এ ধরনের সিদ্ধান্ত, হিজড়া সম্প্রদায় এবং মূলধারার সমাজের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে এবং নৃবিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ দত্তের মতে, সমাজ এ ধরনের ব্যবহারকে দেখে, "অমার্জিত, অপ্রশংসনীয় এবং অশোভন হিসেবে।"[3]
প্রচার মাধ্যমগুলো হিজড়াদের সম্পর্কে বাজে ধারণা ছড়ানোর ব্যাপারে একটি ভূমিকা পালন করে। উদাহরণসরূপ, ভিক্ষাবৃত্তি অথবা পয়সা সংগ্রহকে মিডিয়া "চাঁদাবাজি / আক্রমনাত্বক" রুপে দেখে।"[4] হিজড়াদের প্রায়ই "নপুংসক"[5] বলে অথবা ভিক্ষা করে বড়লোক হওয়ার উদাহরণসরূপ দেখা হয়। ২০১৫ সালে একটি বাংলাভাষী সংবাদপত্র তাদের শিরোনাম করেছিল: "তারা হিজড়া হয়ে রাতারাতি লাখপতি হয়ে গিয়েছিল।"[6]
অনেকের হিজড়াদের সাথে সীমিত যোগাযোগ রয়েছে এবং যখন তারা হিজড়াদের সংস্পর্শে আসে, তা প্রায়ই টাকা চাওয়া কেন্ধ করে অথবা আশীর্বাদ অনুষ্ঠানে। একজন বিশেষজ্ঞ হিউমেন রাইটস ওয়াচকে বলেন যে, যদি কাউ টাকা দিতে অস্বীকার করে, তবে তা হিজড়াদের মাঝে উত্তেজনার সৃষ্টি করে:
টাকা সংগ্রহ সবসময় একটি সহজ প্রক্রিয়া না, এটা অবমাননাকর হতে পারে। যাদের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে, তারা বিক্ষুব্ধ হলে হিজড়ারা গালিগালাজ ব্যবহার করতে পারে কিংবা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে। যার ফলাফলস্বরূপ, সেই ব্যক্তি কখনও হিজড়াদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করবে না কারন তারা মনে করে যে এই হিজড়া আমার কাছ থেকে অন্যায় ভাবে টাকা আদায় করেছে।[7]
দ্বিতীয়া, ঢাকায় বসবাসকারী একজন হিজড়া, হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে: "মানুষ মনে করে হিজড়ারা অনেক খারাপ। তাদের কথা বলার ভঙ্গি অনেক বাজে। তারা নম্র-ভদ্র হতে জানে না। 'তারা তাদের পরনের কাপড় কোনো কারণ ছাড়াই খুলতে পারে। 'এই [ধারণার] জন্যে শুধুমাত্র আমি কেনো দায়ী?"[8]
যদিও হিজড়ারা বৈষম্যের শিকার ও সমাজ থেকে বিচ্যুত, তাদের বেঁচে থাকার প্রথাগত উপায় সামাজিক নিয়ম লংঘন করে। ফলশ্রুতিতে, তাদের ব্যবহার দেখা হয় "অভদ্র অবৈধ এবং / অথবা রাজনৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য", তা তাদের আরও দূরে ঠেলে দেয়।[9]
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সাক্ষাৎকার নিয়েছে বাংলাদেশের কলঙ্ক, বৈষম্য ও সহিংসতার মুখপাত্রের- প্রায়ই জীবনের প্রথম থেকে হিজরাদের পরিবার ও বাড়িগুলোতে গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে হয়। অনেকে তাদের পরিবার দ্বারা গুরুতর শারীরিক সহিংসতা শিকার হয় এবং স্কুলে, কাজে অথবা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে অনেকে হয়রানি ও বৈষম্যের শিকার হয়। তারা একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে ভোট নিবন্ধনের মত প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সম্পাদনে অসুবিধার কথা উল্লেখ করেছে, সরকারী কাগজপত্র হিজড়াদের সবসময় সাথে রাখতে হয় যেখানে তাদের লিঙ্গ ভ্রান্তভাবে "পুরুষ" বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, লিবনি টি, ঢাকায় অবস্থানরত একজন হিজড়া, হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে: "আমরা আমাদের পরিবার দ্বারা সবচেয়ে ভয়াবহ শারীরিক ও মৌখিক হয়রানির শিকার হই এমনকি কিছু সামাজিক বৈধতা আইনগতভাবে অন্যদের সমান হিসেবে দেখা স্বত্বেও, হিজড়াদের প্রায়ই ভিন্ন ও বহিরাগত হিসেবে দেখা হয়েছে- তাদের স্বত্বা একটা বাঁধা ও সীমার মধ্যে বেঁধে রাখা হয়েছে, কিন্তু কোনো অধিকার দেয়া হয়নি।“ লিবনি টি. "অগণিত বিধিনিষেধ" বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: "আমি আমার ইচ্ছা অনুযায়ী অবাধে বা স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারিনা। স্বাধীনভাবে কিছু পরতেও পারিনা।"[10]
হিজড়া সম্প্রদায়ের একটি স্বতন্ত্র সামাজিক নিয়মনীতি আছে যার দায়ভার একজন গুরু (নেতা) তার চেলার (শিষ্য) অথবা অন্য হিজড়াদের উপর অর্পিত যারা তার সাথে থাকে এবং অধীনে কাজ করে।[11]
শক্তবন্ধনে আবদ্ধ হিজড়া সম্প্রদায় হিজড়াদের একটি সামাজিক সুরক্ষার আশ্বাস দেয়, কিন্তু এই সুরক্ষা তাদের যথাযথ সামাজিক মর্যাদা দিতে পারেনা। তার উপরে গুরু-চ্যালা সম্পর্কের শ্রেণীবৈষম্য অনেকসময় শোষণমূলক এবং অবমাননাকর। হিজড়া সম্প্রদায় হয়ত কিছুক্ষেত্রে হিজড়াদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে কিন্তু অনেকসময় অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে না।
গুরু-চেলা সম্পর্কের কাঠামো পারিবারিক ও অর্থনৈতিক হয়।[12] হিজড়ারা প্রায়ই ভালবেসে তাদের গুরুকে "গুরু-মা" এবং চ্যালাদেরকে "সন্তান" হিসেবে গণ্য করে। একজন হিজড়া কর্মী বলেছেন : "একজন চেলা তার গুরু দ্বারা একই সাথে ভালবাসা ও নিপীড়নের শিকার হয়।"[13]
ডিএফআইডি দ্বারা একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, যখন চ্যালারা ভিক্ষাবৃত্তি বা একটি নবজাত শিশুকে আশীর্বাদ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, তাদের গুরু সাধারণত তাদের খাবার খরচের টাকা ছাড়াও মোট আয়ের ৫০ শতাংশ নিয়ে নেয়।[14] এছাড়া গুরুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার জন্য কঠোর নিয়ম রয়েছে, যা ঢাকায় বসবাসরত একজন হিজড়া, বর্ষার মতে, একজন সন্তানের তার পিতামাতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সমতুল্য।[15] উদাহরণসরূপ, যদি একজন গুরু তার কোনো "সন্তান" এর কোনো জিনিষের প্রশংসা করে তবে চ্যালাদের তা গুরুকে উৎসর্গ করতে হবে, তা যেকোনো মূল্যেরই হোক না কেন। যদি কোনো চ্যালা তা না করতে চায়, তবে ঢাকায় বসবাসরত আরেকজন একজন হিজড়া, নাবিলার মতে, [গুরু] খুব খারাপ ব্যবহার করে এবং যা তা বলে। প্রয়োজনবোধে তারা গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা বোধ করেনা।"[16]
এছাড়া গুরুরা তাদের চ্যালাদের জন্য আশ্রয় এবং খাদ্য সরবরাহ করে এবং তাদের জন্য অর্থ উপার্জনে পথ খুঁজে দেয় যেমন : যৌন কর্মীর কাজ।[17] ঢাকার এক হিজড়া জ্যোতি পি. বলেছেন যে যৌন কর্ম করার জন্য "একজন গুরু থাকা আবশ্যক....যদি আমি [যৌনকর্মী] একা থাকি অন্য হিজড়াদের ছাড়া, তারা আমাকে তা করতে দেবে না।[18] কিছুক্ষেত্রে, গুরুরা তাদের চ্যালাদের উপর শারীরিক অত্যাচার ও গালিগালাজ করে, তাই একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবিকা তাদের এ অবমাননাকর পরিবেশ থেকে মুক্তি দেবে। উদাহরণসরূপ, ঢাকার এক হিজড়া যিনি তার পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেছেন, তিনি সরকারী চাকরীর গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন:
যদি আমি আমার গুরুকে ছেড়ে যাই, তিনি আমাকে মারধোর করবেন। যদি আমি তাকে ছেড়ে অন্যকোনো কর্ম সংস্থানের জোগাড় করি, তবে তিনি আমার চুল কেটে দেবেন, আমাকে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেবেন... তিনি আমাকে অনেক ভয় দেখান। সেজন্য আমি তাকে ছেড়ে যেতে পারবনা। কিন্তু ] যদি আমি একটি সরকারী চাকরী পাই, তবে তিনি আমার কিছুই করতে পারবেননা। কারণ এটা সরকারী চাকরী এবং আমি আমার যোগ্যতা অনুসারে তা অর্জন করেছি।[19]
হিজড়াদের শ্রেণী এবং বর্ণ
বেশিরভাগ হিজড়ারা তাদের পরিবারের কাছে গ্রহনযোগ্য নয় এবং একটি কিশোর বয়সে তারা আলাদা হয়ে যায়।[20] সমাজে বিরূপ ধারণার কারনে, তাদের কর্মসংস্থান ভিক্ষাবৃত্তি অথবা যৌন কর্মের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ।[21] কিছু হিজড়া গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অথবা রেস্টুরেন্টে কাজ করে, কিন্তু তারা বেশীর ভাগ সময় চাকরী ধরে রাখতে পারে না ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ, যৌন নির্যাতন অথবা তাদের “মেয়েলি আচরণের” জন্য হয়রানির কারনে।[22] এ ধরনের বৈষম্য নিম্ন বর্ণের দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়। তাছাড়াও তা দেখা যায় বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেতনের, কাজের লোক এবং নির্দিষ্ট পেশার কিছু লোকের মধ্যে যেমনঃ জেলে, মুচি এবং মেথর।[23]
লিভিং স্মাইল বিদ্যা, ভারতের একজন দলিত হিজড়া থিয়েটার শিল্পী যিনি হিজড়া এবং দলিত সম্প্রদায়ের এক ও অভিন্ন সংগ্রামের সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করেন, বলেছেনঃ
উভয় দলিত ও হিজড়াদের সম্প্রদায়গুলিতে এই পেশাগত অপরিবর্তন, অন্যান্য বিকল্প পথগুলো বন্ধ করার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে। তাই, অন্যান্য বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে পরিষ্কার করার কাজগুলো [মানুষের মলমূত্র পরিষ্কার করা দলিতদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে[24]; একইভাবে, বিকল্প কাজের অভাবে ভিক্ষাবৃত্তি ও যৌনকর্ম হিজড়াদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ।[25]
শ্রেণীভেদে বৈষম্য এবং হিজড়াদের প্রতি বিরুপ ধারণা, হিজড়াদের বর্তমান শঙ্কটের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।[26] বাংলাদেশে শ্রেণীবিভাগ প্রথা যেভাবে কাজ করে, তা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা। এই শ্রেণীবৈষম্য ব্যাপকভাবে স্বীকৃত নয় কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষের সম্পর্ককে প্রভাবিত করে- বিশেষ করে নিচু শ্রেণীর মানুষের সাথে।[27] বাংলাদেশে কিছু গবেষকের মতে হিজড়ারা বৃহত্তর(অথবা সর্বনিম্ন) দলিতের মধ্যে পড়ে,[28] হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাক্ষাৎকারে সাক্ষাতকারীরা শ্রেণীভেদে তাদের সামাজিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে। [29]
আবার অন্যরা মনে করে হিজড়ারা একটি পৃথক নিম্নজাতের সম্প্রদায়। অর্থনৈতিক শ্রেণীবৈষম্য সাধারণ জীবনযাত্রায় একটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ব্যবসা মালিকরা মনে করে যে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিম্ন-শ্রেণীর মানুষের উপস্থিতি অন্যান্য গ্রাহকদের দূরে সরিয়ে দেয়, আবার কিছু গ্রাহক ঢুকতে অস্বীকৃতি জানায়।[30] হিজারারা একই বৈষম্যের শিকার। একজন হিজড়া সমাজ কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেনঃ আমরা যদি একটি ঘরভাড়া করতে চাই, বাড়ির মালিক আমাদের ভাড়া দেয় না। তারা বলবে, 'একজন হিজড়া? না, আমি আপনাদের ভাড়া দেব না।’ আমি যদি বাসে চড়ি এবং আমার পাশে একটা সিট খালি থাকে, কেউ সেখানে বসবে না। তারা মনে করে আমার একটু স্পর্শ লাগলেই তাদের পাপ হবে।[31]
রিমা সি. হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণে শ্রেণীবিভাগের ভূমিকা, যা শ্রেণী বৈষম্য প্রথার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ব্যাখা করতে গিয়ে বলেন “আমার মত মানুষেরা বেশিরভাগক্ষেত্রে খুব দরিদ্র পরিবার থেকে আসে। খুবই দরিদ্র পরিবার। যদি আমরা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিতাম, তাহলে মানুষ আমাদেরকে এইভাবে নির্যাতন করতে পারতনা। আমরা গরীব, শুধুমাত্র এইকারনে আমরা প্রতিদিন নির্যাতিত হই।” বাংলাদেশের একটা গবেষণায় যে হিজড়ারা সাধারণত নিম্নবর্গ বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে।[32]
হিজড়াদের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা ও নিরাপত্তা শুধুমাত্র আইনি স্বীকৃতি মাধ্যমে নিশ্চিত করা যাবে না-তার জন্য তাদের সমাজের অন্তর্ভুক্ত ও দারিদ্র্য থেকে অব্যাহতির জন্য পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। তাই ২০১৪ সালের শেষের দিকে সরকার দ্বারা গৃহীত কর্মসংস্থান কর্মসূচি, হিজড়াদের অধিকার সংরক্ষন বাস্তবায়নে একটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি।
হিজড়াদের স্বীকৃতি
যখন আমরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, মানুষ আমাদের দেখে শিষ দেয় এবং আমাদের প্রতি বাজে মন্তব্য করে। তারা আমাদের হয়রানি করে। আমরা স্বীকৃতি চাই যাতে অন্যদের মত রাস্তা দিয়ে শান্তিতে হাঁটতে পারি। যাতে কেউ আমাদের হয়রানি করতে না পারে এবং কেউ আমাদের অবজ্ঞা করতে না পারে। আমি স্বীকৃতি চাই সমাজের মধ্যে থাকার জন্য, যাতে আমাদের বৈষম্যের শিকার না হতে হয়। কিন্তু আমাদের এ স্বীকৃতি পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
- সাইমা আর, ঢাকা, অক্টোবর ২০১৫
২০০৯ সালে বাংলাদেশে হিজড়াদের উপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, "হিজড়া জীবনের সবচেয়ে বঞ্চনাকর বিষয় হছে তাদের পুরুষ-মহিলার ঊর্ধ্বে একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দান করা যা তাদের বৃহত্তর সমাজের অংশ হিসেবে সম্ভবনাময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপনে বাঁধা দেয়।”[33] তাই যখন ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রীসভা হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ঘোষণা করে, এ সম্প্রদায় নতুন করে আশার আলো খুঁজে পায়।[34] এবং এক বছর পর, যখন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুসারে তাদের কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। এতে ১২ জন হিজড়ারার সরকারী চাকরির ব্যবস্থা হয়, যা তাদের দৈনন্দিন চাহিদা পূরণের একটি অন্যতম পথ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল।
মন্ত্রিসভার ঘোষণা, অন্যান্য অঞ্চলের অগ্রগতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ রেখে, আইনগতভাবে হিজড়াদের একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সেইসাথে ২০০৭ এবং ২০০৯ সালে নেপাল ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট একই ঘোষণা দেয়। ভারতের কিছু অংশে নীতিমালা পরিবর্তন করে সরকারী কাগজপত্রে কিছু মানুষদের নিজস্ব লিঙ্গ নির্ধারণের সুযোগ দেয় এবং জাতীয় সরকার পাসপোর্ট ও ২০১১ সালের জাতীয় আদমশুমারিতে একটি তৃতীয় লিঙ্গ বিভাগ অন্তর্ভুক্ত করে।
নেপাল ২০০৭ সালে, নেপালের সুপ্রিম কোর্ট তৃতীয় লিঙ্কে স্বীকৃতি দান করে।[35] এতে সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে যে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতিদানের কাগজপত্র শুধুমাত্র তাদের “নিজ-অনুভূতির” উপর ভিত্তি করে প্রদান করা হবে, স্বাস্থ্য কর্মী অথবা কোর্টের মতামতের উপর ভিত্তি করে নয়।[36]-সনাক্তকরনের প্রক্রিয়ায়, যৌন প্রবৃত্তি ও লৈঙ্গিক পরিচয়ের আরও কিছু তালিকা তৃতীয় লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০১১ সালে, নেপাল জাতীয় আদমশুমারীতে তৃতীয় লিঙ্গের তালিকা অন্তর্ভুক্ত করে, এবং অক্টোবর ২০১৫ থেকে নেপালি নাগরিকদের সফলভাবে বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্টে ফিমেল(মহিলা) এর “এফ” অথবা মেল(পুরুষ) এর “এম” ছাড়াও আদার(অন্যান্য) এর “ও” তালিকা দেয়া হয়েছে।[37] |
***
ভারত ২০১৪ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে হিজড়াদের আইনত একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে।[38] তারা ঘোষণা করে এটি "একটি সামাজিক বা ডাক্তারী বিষয় নয়” বরং মানবাধিকারের বিষয়। আদালত বলে যে লৈঙ্গিক পরিচয়ের[39] আইনগত স্বীকৃতির জন্য কোনো শারীরিক পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। ২০১৫ সালে দিল্লি হাই কোর্ট আইন প্রয়োগ বাস্তবায়ন করে, “প্রত্যেকেরই একটি মৌলিক অধিকার রয়েছে তাদের নিজস্ব লিঙ্গ পরিচয়ে স্বীকৃত হবে” এবং “লৈঙ্গিক পরিচয় এবং যৌন প্রবৃত্তির মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকার জন্মগত।”[40] সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টায়, সরকার আগস্ট ২, ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপন করে। যদিও বিলটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিশীল প্রচেষ্টা তারপরও বিলটি কিছু উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। এ বিল হিজড়াদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে “না পুরোপুরি মহিলা, না পুরোপুরি পুরুষ” হিসেবে এবং আইনগত ভাবে লিঙ্গ স্বীকৃতি প্রদানের প্রয়োজনবোধে দুটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষের থেকে অনুমোদন গ্রহণ চাওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা একজন মানুষের স্বকীয়তা বজায় রাখে না এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সম্মান করেনা।[41] এ বিল “হিজড়াদের ভিক্ষাবৃত্তির কাজে বাধ্যকারী বা প্ররোচনামূলকারীদের” আসামী হিসেবে গণ্য করে,” যা স্থানীয় হিজড়াদের মাঝে ভীতির সৃষ্টি করে যে পুলিশ গরিব হিজড়াদের লক্ষ্য বানাতে পারে, এমনকি তাদের নেতা অথবা গুরুদের গ্রেফতার করতে পারে। এছাড়াও এ বিলটি বৈষম্যের একটি স্পষ্ট সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হয়, এবং সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী হিজড়াদের জন্য শিক্ষা এবং কাজের সুবিধা প্রদান করা সম্ভবপর কিনা সে বিষয়টি নিয়ে কিছুই বলেনা ।[42] |
***
পাকিস্তান
২০০৯ সালে, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট হিজড়াদের অধিকারের সুনিশ্চিত করতে সব প্রাদেশিক সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানায়। রায়ে বিশেষভাবে হিজড়াদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ উন্নত করা ও দায়েরকৃত মামলায় সমন্বয় করার জন্য বলা হয়েছে। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্ট হিজড়াদের জন্য নাগরিক নিবন্ধন প্রক্রিয়া উন্নত করার জন্য প্রাদেশিক সমাজকল্যাণ বিভাগের প্রতি নির্দেশ দিয়েছে এবং তাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে নিবন্ধন করার অনুমতি দিয়েছে। আদালত নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর প্রাদেশিক সরকারকে রিপোর্ট জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছেঃ হিজড়াদের সাম্প্রতিক অবস্থা, কর্তৃপক্ষ দ্বারা ভোটার তালিকায় হিজড়াদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের সম্পত্তি রক্ষার অধিকার। আদালত হিজড়াদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ও সুরক্ষা হিজড়াদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। |
***
শ্রীলংকা
শ্রীলঙ্কা লিঙ্গ স্বীকৃতকরণ পদ্ধতি গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করছে। তাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে কাজ করে একটি "লিঙ্গ স্বীকৃতি সার্টিফিকেট" প্রস্তাব করেছে যা সরকারী কাগজপত্রে লিঙ্গ পরিবর্তন করার অনুমতি দেবে। এই প্রস্তাবনা সামনে এগিয়ে যাবার জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু এ সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য কর্মী অথবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে প্রমাণ আনতে হবে যা আন্তর্জাতিক নীতিমালার অংশ নয়। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, বা মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজনীয় নয়।[43] |
এমনকি ২০১৪ সালে মন্ত্রিসভার নির্দেশের আগে, সরকার এবং বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন সময়ে হিজড়াদের অস্তিত্ব স্বীকার করেছে এবং তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। ২০১২ সালে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি ছোট কর্মসূচির হাতে নিয়েছিল যেখানে হিজড়া ছাত্রদের উপবৃত্তি এবং কর্মস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। ধীরে ধীরে এ কর্মসূচির প্রসার এবং বাজেট বাড়ে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে, এ পরীক্ষামূলক কর্মসূচির আওতায় ৬৪ টি জেলায় শিক্ষামূলক বৃত্তি, কারিগরি প্রশিক্ষণ, এবং বয়স্ক ভাতা প্রদান করা হয়।[44]
২০১৫ সালের একটি আলোচিত কেসের পর হিজড়ারা প্রকাশ্যে স্বীকৃতি অর্জন করে যেখানে একজন হিজড়া দৌড়ে একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারের হত্যাকারীদের ধরে ফেলে। তার কিছুদিন পর, সরকার তাকে এবং অন্যান্য হিজড়াদের ট্রাফিক পুলিশ[45]হিসেবে নিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করে। ঢাকার মেয়র, আনিসুল হক, পরিবারদের তাদের হিজড়া সন্তানদের সহায়তা করার, তাদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করার এবং হিজড়া সম্প্রদায় সম্পর্কে নিয়োগকারীদের অবহিত করার জন্য একটি সম্মেলন আয়োজন করেন।[46]
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হিজড়াদের দ্বারা দায়েরকৃত একাধিক অভিযোগ গ্রহণ করেছে যা কর্মসংস্থানে বৈষম্য থেকে শুরু করে লিঙ্গ শনাক্ততকরনে পুলিশের অনিয়ম পর্যন্ত বিস্তৃত।[47]২০১৪ সালে জাতীয় প্রতিশ্রুতি এবং নীতিপ্রণয়ন, সরকার ও জাতিসঙ্ঘের যৌথ উদ্যোগে এইচ আই ভি এবং আইনের মূল্যায়নে উল্লেখ করা হয়েছে যে একটি তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে হিজড়াদের প্রতি সরকারের স্বীকৃতি যদিও একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু সহিংসতা, কলঙ্ক, এবং বৈষম্য হিজড়াদের জীবনের সাথে এখনও জড়িত।[48] বাংলাদেশ উন্নয়ন রিপোর্ট ২০১৫ তে, ইউএনএইডস সুপারিশ করে যে, “হিজড়াদের স্বীকৃতি…সরকারি নীতি, নথি, কর্মসূচি এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের দেয়া উচিত।“[49]
হিজড়াদের বাংলাদেশের আইন ও নীতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগটি প্রশংসার যোগ্য, বিস্তারিতভাবে বলা যায়, যদি সরকার হিজড়াদের ভালো অবস্থানে দেখতে চায়, তবে একটি সুস্পষ্ট, ও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিত যাতে হিজড়ারা তাদের নতুন আইনগত স্বীকৃতির কাগজপত্র অর্জন করতে পারে।
কার্যপ্রণালী ও পূর্বধারণা
একটি স্বাগতবার্তা
ডিসেম্বর ২০১৪ সালে, প্রায় ৪০ জন হিজড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিম্নস্তরের সরকারি চাকরির জন্য আবেদন করে। পদ্মা আর., একজন ২৪ বছর বয়সের হিজড়া, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কে বলেছেন, তিনি সরকারী ঘোষণা দেখার পরে, ছেলেবেলায় ঘর থেকে বিতাড়িত হওয়া সহ তার জীবনের সব সমস্যার সমাধানের জন্য একটি আশার আলো দেখেছিলেন। সেই আশার আলো হল একটি চাকরী।[50] রিমা সি., ২৬ বছর বয়স্ক হিজড়া ব্যাখা করেন যে, “এটা অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের ব্যাপার…আমরা যেখানেই যেতাম, সেখানে মাত্র দুটি লিঙ্গ ছিল…আমাদের কোনো জায়গা ছিলনা। আমরা নিজেদেরকে এ দেশের নাগরিক মনে করতাম না…যখন সরকার আমাদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিলো, তা ছিল আমাদের জন্য একটা আনন্দের ঘটনা।"[51]
এ পরীক্ষামূলক কর্মসূচি বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠানে ১৪টি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে যেমন স্কুল, আশ্রয়কেন্দ্র, এতিমখানা ও ডে-কেয়ার সেন্টার। এ পদগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিচারক, প্রহরী ও নৈশপ্রহরী, মাসিক বেতন অনুযায়ী ৬৯০০ টাকা (৮৮ ইউএস ডলার) থেকে ৭৮০০ টাকা(১০০ ইউএস ডলার) পর্যন্ত। বেশিরভাগ পদগুলোর নিয়োগ দেয়া হবে ঢাকায়, বাকি ২ টি চট্টগ্রাম ও ১টি মুন্সিগঞ্জে।[52]
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, ১২ জন নির্বাচিত হিজড়া সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে প্রথম পরিচয়েই বুঝে গিয়েছিল যে কর্মকর্তাদের হিজড়াদের সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। এই অসচেনতা প্রমাণ করে যে হিজড়াদের মর্যাদা দেয়া হয়নি এবং চাকরির মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের আশাও সেই সময় তাদের মধ্য থেকে হারিয়ে গিয়েছিল।
সাক্ষাৎকার
ডিসেম্বর ২০১৪ সালে, সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ে ইন্টার ভিউ দ্রুত প্রহসনে পরিণত হয়। রিমা সি বর্ণনা করেন কিভাবে ইন্টারভিউ দলের সদস্যরা তাদের পোশাকের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেনঃ “আপনি যখন একটি ইন্টারভিউ এ যান, তখন কি নিজেকে আপনি ভালভাবে উপস্থাপন করতে চান? আমরা অবশ্যই তা চেয়েছিলাম। তখন তারা আমাদের জিজ্ঞেস করল, “আপনি এভাবে এসেছেন কেন? আপনি মেইক আপ করেছেন কেন? এভাবে কাজ হবে না।” প্রত্যেকেই এ প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তারা খুশি মনে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুত আছেন। প্যানেলের সদস্যরা তুরভি এ. নামক হিজড়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ
“আপনি এভাবে [এ চেহারা নিয়ে] চাকরী পেতে পারেন না।” তাহলে আমার কি করা উচিত? তখন তারা বলল, “আপনাকে পুরুষের পোশাক পরে কাজ করতে হবে। আপনি এই পোশাকে আসতে পারেন না। মানুষ আপনাকে দেখে ভয় পাবে।” তখন আমি তাদের বললাম, “যদি আমি এ চাকরী পাই, তাহলে আমার প্যান্ট ও শার্ট পরতে কোনো আপত্তি নেই। [তারা আমাকে উত্তর দিল] এখানে অনেক বড় কর্মকর্তারা কাজ করেন, তারা যদি আমাকে দেখে অস্বস্তিবোধ করেন, তাহলে আমার সাথে সহজ হতে পারবেন না। তারা আমাকে অপমান করবেন। সেজন্য, আমি আমার চুল কাটা সহ সবকিছু করতে রাজি হলাম। তখন তারা বলল, ঠিক আছে, তাহলে সব কিছু করুন। চুল ছোট রাখুন এবং কাজে প্যান্ট-শার্ট পরে আসুন।[53]
সমাজকল্যাণ বিভাগে অপমানজনক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও, ১২ জন হিজড়া যারা কর্মসংস্থান কর্মসূচির জন্য নির্বাচিত হয় তারা তাদের প্রস্তুতি চালিয়ে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়।
তাদের কেউ কেউ ইন্টারভিউকারীদের অপমানজনক পরামর্শ গ্রহণ করে এবং তারা চুল ছোট করে কেটে ফেলে যাতে তাদের পুরুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যরা, একটি উন্নত জীবনের প্রত্যাশায়, যৌনকর্ম ছেড়ে দেন এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে তাদের বন্ধন ছিন্ন করেন। এই সিদ্ধান্ত এই জন্য যে তাদের জীবনে পরিবর্তন আসবে। এ ব্যাপারে তাদের আস্থা ছিল, যদিও তাতে ঝুঁকির আশঙ্কা ছিল। এই হিজড়ারা তাদের প্রথাগত আয়ের পথ ত্যাগ করে, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়। “আমি একটি আশার আলো খুঁজে পেলাম, তাই সব কিছু ছেড়ে দিয়েছিলাম….ঘরে যাবার পর আমি টাকা সংগ্রহ [ভিক্ষাবৃত্তি] বন্ধ করে দেই।” তুরভি এ. বলেছেন।[54]
কোনো খবর ছাড়া প্রায় ছয় মাস অপেক্ষার পর, হিজড়ারাদের একটি ফোনকলের মাধ্যমে জানানো হয় যে তাদের একটি সরকারী হাসপাতালে গিয়ে শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে।
মিরা টি. একজন হিজড়া যিনি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন। তিনি বলেনঃ “আমাদের যা করতে বলা হয়েছে, আমরা তা করেছি এবং আশা করেছিলাম আমাদের চাকরীটা হয়ে যাবে। আমাদের বলা হয়েছিল সরকারী চাকরী পাবার জন্য একটি ভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে।”[55] রিমা সি. অন্য একজন হিজড়া যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে, বলেছেনঃ “আমরা সেখানে যাবার সাহস সঞ্চয় করেছি কারণ আমরা একটি চাকরি চাই। আমি এই অপমানের জীবন আর চাই না। আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই।”[56]
একটি তথাকথিত শারীরিক পরীক্ষা
২৭ শে জানুয়ারী, ২০১৫ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় একটি স্মারকলিপি প্রকাশ করে যেখানে অনুরোধ করা হয় যে “শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত হিজড়া শনাক্তকরনের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।”(চিঠিটি পরিশিষ্ট ১ এ যুক্ত করা হয়েছে)। এ স্মারকলিপি “হিজড়াদের” কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা প্রদান করে নি এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের কোনো সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়নি যে কাদের “প্রকৃত হিজড়া” বলে শনাক্ত করবে যা হিজড়াদের প্রতি লাঞ্ছনার পথ খুলে দেয়।
মে থেকে জুলাই ২০১৫ এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, ঢাকার সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ও চিকিৎসকদের নির্দেশে হাসপাতালের কর্মীরা “শারীরিক পরীক্ষার” নামে হিজড়াদের লাঞ্ছিত করেন। কিছু হিজড়ারা একদিনের জন্য এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান; অন্যান্যরা চিকিৎসকের নির্দেশ অনুযায়ী সপ্তাহের মধ্যে একাধিকবার ফিরে আসতে বাধ্য হন।[57]
প্রথম দিন, মে ২৬ অথবা ২৭ তারিখ, যখন হিজড়ারা এসে পৌঁছান, একজন পুরুষ এবং মহিলা চিকিৎসক তাদের একটি ছোটও রুমে নিয়ে যান এবং তাদের পরনের কাপড় খুলতে বলেন। “যখন আমরা কাজ [যৌন কর্ম] করি, আমরা তখন পরনের সব কাপড় খুলি না। সবাই মনে করে যে যৌনকর্মের সময় আমরা বলার সাথে সাথে কাপড় খুলে ফেলি, যদি আমরা তা খুব কম করি। কিন্তু তারা [হাসপাতালে] আমাদের সব কাপড় খুলতে [উলঙ্গ] বলে,” মিরা টি. বলেছেন।[58]
এ প্রক্রিয়া চলাকালে, হাসপাতালের কর্মীরা হিজড়াদের অবাধ এবং পরস্পরবিরোধী নির্দেশনা দিয়েছিলেন। রিমা সি. বলেছেনঃ
আমরা যখন সেখানে যাই, তারা প্রথমে আমাদের একটি টেবিলের উপর শুতে বলে। তখন তারা আমাদের বলে যে তোমাদের শুতে হবে না, দাঁড়িয়ে থাকো। দাঁড়ানোর পর, [তারা বলে] পরনের সব কাপড় খোলো। আমরা দ্বিধার সাথে বললাম, সব মানুষের সামনে….তারা বলল তোমরা এখানে পরীক্ষার জন্য এসেছ, তাই তোমাদের তা করতে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে। আমরা আমাদের পরনের সব কাপড় খুলেছিলাম।[59]
সাক্ষাৎকার প্রদানকারীরা জানিয়েছে যে তদের তিনটি[60]মেডিক্যাল পরীক্ষা দিতে হয়েছেঃ একটি শারীরিক পরীক্ষা, একটি আল্ট্রাসাউন্ড এবং আরও একটি পরীক্ষা যাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বর্ণনা করেছেন “ফরেনসিক” পরীক্ষা হিসেবে। লিবনি টি. বলেছেনঃ “সরকার হিজড়ার সংজ্ঞা জানেনা। হিজড়া কারা অথবা তারা কিভাবে হিজড়া হল, তা তারা বোঝেনা। তারা আমাদের [হাসপাতালে] পাঠিয়েছে এমন কর্মীদের কাছে যাদের এ বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই এবং যাদের হিজড়াদের সাথে কাজ করার কোন অভিজ্ঞতাও নেই।”[61]
শারীরিক পরীক্ষা
সাক্ষাৎকার দানকারীরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে যে, প্রথম পরীক্ষার সময়ে, চিকিৎসকেরা, হাসপাতালের প্রহরী ও কর্মীরা রুমে উপস্থিত ছিল। লিবনি টি. এর মতেঃ
আমাদের একটি রুমে পাঠানো হয়েছে যেখানে আমাদের সাথে কেউ কথা বলছিল না, তারা আমাদের [সবার সাথে] দূরত্ব রেখে দাঁড় করিয়েছিল। তখন তারা আমাদের প্যান্ট খুলতে বলে, অন্য একজন আমাদের শার্ট খুলতে বলে। [চিকিৎসকেরা] তারা আমাদের শরীর, বুক এবং পেছনের অংশ স্পর্শ করছিল। তারপর তারা অন্য একজন লোক কে নিয়ে আসে এবং তাকে আমাদের কাপড় খুলতে বলে। এটা আমাদের জন্য কষ্টকর এবং লজ্জাজনক ছিল কারন সেখানে অনেক মহিলা ছিল।[62]
রিমা সি. বলেছেনঃ “এটা লজ্জাজনক ছিল। তারা আমাদের নগ্নভাবে পরীক্ষা করেছিল….এটা মেডিকেল পরীক্ষা। সেখানে চিকিৎসকদের থাকার কথা। প্রহরী অথবা অন্য কোনো কর্মীদের নয়। তারা চিকিৎসক নয়…চিকিৎসকদের আমাদের পরীক্ষা করার কথা, তাদের নয়।”[63] যখন তিনি নগ্ন হয়েছেন, চিকিৎসকেরা স্বাস্থ্য কর্মী ছাড়া হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন রিমা সি. এর শিশ্ন ধরতে এবং তাকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেঃ
তারপর তারা আমার ব্যক্তিগত অংশ বিভিন্ন ভাবে ধরেছিল। তারা আমাদের স্পর্শ করতে ঘৃণা বোধ করছিল তাই তারা হাশপাতালের জমাদারকে এটা করতে বলে… তারা হাসপাতালের কর্মীদের আমাদের ব্যক্তিগত অংশ গ্লাভস পরে ধরতে বলে। তারা আমার শিশ্ন ধরে…..এবং বলে না না, আপনি কি ধরনের হিজড়া? তারা মনে করেছিল হিজড়া মহিলাদের মত হবে এবং একজন হিজড়া ও মহিলার একই শারীরিক বৈশিষ্ট্য হবে।”[64]
রিমা সি. বলেছেন চিকিৎসকেরা তার শরীরের লোম নিয়ে কথা বলছিল; “তারা জিজ্ঞেস করেছিল। আপনি দাঁড়ি কামান? আমি জবাব দিয়েছিলাম হ্যাঁ, আমাকে কামাতে হয় কারন আমার দাঁড়ি আছে। একজন লোকের দাঁড়ি কামাতে হয়। আমি একজন নারী নই, আমি হিজড়া।” পরীক্ষার জন্য উপস্থিত চিকিৎসক রিমা সি. কে স্পর্শ করতে প্রত্যাখ্যান করে। তিনি বলেছেনঃ
তারা অন্য একজনকে আমাদের শরীর স্পর্শ করতে নির্দেশ দেয়, যেমনঃ এই জায়গায় জেল লাগিয়ে দাও, দেখ এখানে সব ঠিক আছে কিনা। তারা মনে করেছিল আমরা যদি পুরুষ হতাম, তাহলে এতগুলো পুরুষ ও মহিলার সামনে আমাদের শিশ্ন খাড়া হত। কিন্তু কিছুই হয়নি। তারা তা মহিলা চিকিৎসকের সামনে করেছে। মহিলারা জোরে জোরে হাসতে লাগল। তারা আমাকে মানুষ মনে করেনি। মনে হয়েছিল আমি একটি দানব এবং তারা আমাকে দেখে হাসছিল। তারা যেভাবে আমাকে দেখে হাসছিল, মনে হয়েছিল আমি একটি পশু। তারা একজন অন্যজনের সাথে ফিসফিস করে কথা বলছিল। তারা হাসছিল এবং বলছিল, “হায় হায়! আর কত কি যে দেখতে হবে?” তখন আমি হিজড়া হবার প্রকৃত অর্থ বুঝলাম।[65]
তুরভি এর. অভিজ্ঞতাও একই ধরনের ছিলঃ “সেখানে একজন ওয়ার্ডবয় ছিল, সেখানে মহিলারাও ছিল। তারা আমাকে বলল, ‘আপনার গোপন অঙ্গ পরীক্ষা করা হবে।’ আমি একটু দ্বিধার মধ্যে ছিলাম।” তিনি এবার পরিষ্কার করে বললেন যে আমরা আপনার যৌনাঙ্গের কথা বলছিলাম এবং চিকিৎসকেরা বললেন, তারা আমাকে পরীক্ষা করার আদেশ পেয়েছেন। “ তাদের সাথে কিছুক্ষন কথা বলার পরে, আমি ভেবেছিলাম তারা চিকিৎসক। তারা এর জন্য দায়ী নয়। তারা আদেশ অনুযায়ী কাজ করছে,” তুরভি এ. বলেছেন, “তাদের প্রতি বাজে ব্যবহার অথবা গালিগালাজ করার কোনো কারন নেই। আমি আমার লজ্জা, অস্বস্তি সব একপাশে রেখে, আমার কাপড় খুলেছি।” একজন লোক যে সেখানে উপস্থিত ছিল (সে চিকিৎসক কিনা তুরভি তা বলতে পারেনা) গ্লাভস পড়ে তার যৌনাঙ্গ ধরে। তিনি যখন আমাকে পরীক্ষা করেন, আমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত উলঙ্গ ছিলাম……একজন লোক তিনজন মহিলার সামনে আমাকে পরীক্ষা করছিল। তারা কি তা বুঝতে পারেনি, তা আমার জন্য কত আবমাননাকর ছিল? তারপরেও আমি ভেবেছি, এই আবমাননার পরিবর্তে তারা আমাকে একটি চাকরি দেবে। এ চাকরির মাধ্যমে আমি আমার ভরন-পোষণ করতে পারব।”[66]
জ্যোতি পি. প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তাকে একজন চিকিৎসক একটি রুমে নিয়ে যায় এবং একজন পুরুষ চিকিৎসক ও ৩/৪ জন মহিলার সামনে কাপড় খুলতে বলে। জ্যোতি পি. কর্মীদের অনুরোধ করেন তার প্রতি সদয় হতেঃ “আমি তাদের বলেছিলাম, আমাদের এখানে কেউ পাঠিয়েছে। আমরা নিজেদের ইচ্ছায় এখানে আসিনি। তাই দয়া করে আমাদের ভালভাবে পরীক্ষা করেন। এটা বলার পরে চিকিৎসকটি সেখানে উপস্থিত পুরুষ ও মহিলাদের সামনে আমাকে উলঙ্গ হতে বলেন……[67]
চিকিৎসকেরা হিজড়াদের মিথ্যা পরিচয় দেয়ার জন্য দায়ী করেন। লিবনি টি. বর্ণনা করেছেন, কিভাবে তার অন্তর্বাসের ভেতরে কাপড় দেখে তাকে অপমান করা হয়েছেঃ তারা আমার বুকে হাত দেন এবং বলেনঃ’আপনার স্তন নেই, আপনি কি ধরনের হিজড়া? আপনার মাসিক হয়না। তারা খুব অশ্লীল ব্যবহার করেন এবং এটা ছিল অনেক অপমানজনক।”[68] জ্যোতি পি. বলেছেনঃ
আমি আমার মোটা অন্তর্বাস পড়ে সেখানে গিয়েছিলাম। যখন অন্তর্বাসটা খুলে ফেলি, তারা রেগে যায়ঃ আপনি এর ভেতরে কাপড় ঢুকিয়েছেন কেন? আপনি একজন পুরুষ…আপনার অন্তর্বাসের ভেতরেকাপড় ঢুকিয়ে আপনি কি আমাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন? এটা একটা মানসিক সমস্যা……আপনি কি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন? আমরা যদি আপনাকে মারধোর করি, তবেই আপনি ঠিক আচরণ করবেন।’[69]
হাসপাতালের নিরাপত্তা কর্মী ডাক্তারদের নির্দেশে হিজড়াদের বেঁধে রাখে। শারীরিক পরীক্ষার সময়, হাসপাতালের কর্মী লিবনি টি. কে নগ্ন হতে বলে, কিন্তু ধরতে দ্বিধাবোধ করেঃ
তাদের দেখে খুবই দ্বিধান্বিত মনে হয়েছে। তারা আমাকে ধরতে চাননি, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ঠিকই ধরেছেন। তারা আমাদের পরীক্ষা করার জন্য অন্য একজনকে ডাক দিয়েছেন। তারা আমাদের শার্ট খুলতে ও বুক দেখাতে বলেন। আমি আমার শার্ট খুলে ফেলার পর, ৪ অথবা ৫ জন মহিলা আমার বুক, পিঠ ও মুখে হাত বুলাতে থাকে। একজন আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি হেয়ার স্টাইলিস্ট এর কাছে যান? অন্য একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি শরীরের লোম তোলেন?’ অন্য আরেকজন জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনি কি দাঁড়ি কামান?’[70]
তখন চিকিৎসকেরা লিবনি টি. কে তার পায়জামা খুলতে বলেন। রুমের সবার দিকে তাকিয়ে তিনি না খোলার অনুরোধ জানালেন। “কারন আমি আমার লজ্জা ও অস্বস্তির কথা তাদের বলেছিলাম। তারা নিরাপত্তা কর্মীদের ডেকে আনেন,” লিবনি টি. বলেছেন, “তিনি আমাদের জোর করে ধরে পায়জামা খুলে ফেলেন। তারপর পরীক্ষা চলার শেষ পর্যন্ত আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখেন।[71]
আলট্রাসাউন্ড
শারীরিক পরীক্ষার পর হাসপাতাল কর্মীরা আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে বলেন- কি কারনে এ পরীক্ষা করা হবে তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি। কারো কারো এ পরীক্ষা শারীরিক পরীক্ষার দিনে করা হয়েছে; এবং অন্যদের একটি ভিন্ন তারিখে আসার জন্য বলা হয়েছে।
আল্ট্রাসাউন্ড এর সময়, হাসপাতালের কর্মীরা অন্যান্য পরীক্ষার মত বেঁধে রাখা ছাড়াও মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি করেন। হাসপাতালএর কর্মী নন এমন লোকেরা রিমা সি. এর পেটে জেল লাগিয়ে দেয় এবং তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে, “তারা আমাদের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেমন “আপনারা স্তন বৃদ্ধির জন্য ঔষধ সেবন করেন কিনা? আপনারা ইঞ্জেকশান নেন কিনা? হরমোন নেন কিনা?” তিনি আরও বলেন, “তারা হাসপাতাল কর্মী নয় এমন লোকজনদের দিয়ে এ পরীক্ষা করিয়েছেন, যা তাদের নিজেদের করার কথা ছিল। মনে হয়েছিল যারা হাশপাতাল পরিষ্কার করে তাঁরা চিকিৎসক এবং চিকিৎসকেরা দর্শক।”[72]
লিবনি টি. আরও বলেছেনঃ
আলট্রাসাউন্ড সম্পন্ন করার কালে, কিছু লোক আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেয়, দুজন লোক আমার হাত এবং আরও দুজন লোক আমার পা ধরে রাখে। তখন ডাক্তার বাহিরে দাঁড়ান লোক যে রোগীদের লাইন ঠিক রাখে, তাকে ডাকেন এবং তাকে আমার পা ধরে রাখতে বলেন এবং তারপর তারা আমার কাপড় খুলে নেন। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আমি কি নিজে খুলতে পারি?” তারা উত্তর দিল, “না, যে কাপড় খুলছে, তাকে তা করতে দাও।[73]
যখন লিবনিকে উলঙ্গ করা হয় এবং দুইজন লোক তাকে টেবিলে চেপে ধরে রাখে, চিকিৎসকেরা তার দিকে চিৎকার করে নির্দেশ দিতে থাকেঃ
তারা বলেন, ‘না, না এভাবে নয়। ঘুরে বস, এটা-সেটা কর।’ লোকটি আমাকে পাশ ফেরাচ্ছিল,সরাচ্ছিল, উপরে তুলছিল এবং আমার পা ফাঁক করছিল। এটা আমার জন্য খুব লজ্জাজনক ছিল।পাশে বিছানায় একটা মহিলা ছিল। তারপর সেখানে আরেকজন লোক ছিল যে ডাক্তার ছিল না।[74]
একটি তৃতীয় পরীক্ষা
কিছু সাক্ষাৎকারদানকারীরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন তাদের “ফরেনসিক” লিখা একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয় একটি তৃতীয় পরীক্ষার জন্য।[75] অন্যরা বলেছেন পরীক্ষা করার যন্ত্রপাতি আলট্রাসাউন্ড এর মত দেখতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় উভয় পরীক্ষাতে ডাক্তারের নির্দেশে হিজড়াদের শরীরে জেল লাগানো হয় এবং কম্পিউটারের নিবন্ধন অনুযায়ী তৃতীয় পরীক্ষায় আরও জেল ব্যবহার করা হয় যাতে তাদের শিন্ম সাড়া দেয়। কিছু সাক্ষাৎকারদানকারীরা আলট্রাসাউন্ড ও একটি তৃতীয় পরীক্ষা দুটোর কথাই উল্লেখ করেন।
তারা হিজড়াদের কাপড় খোলার নির্দেশ দিলে, হাসপাতালের কর্মচারীরা তাদের সাথে সাথে অপমান করা শুরু করেন। রিমা সি. বলেছেনঃ “তখন তারা আমাদের কাপড় খুলতে বললেন। আমরা একটি মোটা অন্তর্বাস পরেছিলাম। তারা জিজ্ঞেস করল, “আপনাররা এত ছোট স্তনের জন্য এত বড় অন্তর্বাস কেন পরেছেন? আপনাদের বড় স্তন থাকা উচিত। আপনারা কি ধরনের হিজড়া? আপনারা ছদ্মবেশ ধরেছেন।”[76] তিনি আরোও বলেনঃ “এখানে একটি কম্পিউটার, তার সাথে লাগানো একটা যন্ত্র এবং জেল আছে। তারা আমাদের যৌনাঙ্গে যন্ত্রটি চেপে ঘষতে লাগল। আমরা পুরুষ কিনা তা তারা ঘষার মাধ্যমে আমাদের উত্তেজিত করে দেখতে চেয়েছিল। আমাদের শিন্ম সাড়া দেয় কিনা। কিছুই হলনা, তারা দেখল।”[77]
তুরভি এ. বলেছেনঃ
বিছানায় শোওয়ার আগে, তারা আমাকে প্যান্ট খুলতে এবং কোমড়ে লুঙ্গি প্যাঁচাতে বলল। সেজন্য আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। শুয়ে পড়ার পর, তারা আমাকে বলল, এখন এই কাপড়টিও খুলে ফেল। তারা আবারও আমাকে আমার যৌনাঙ্গ দেখাতে বলল। আমি তাদের বললাম, আমি একবার দেখিয়েছি। তখন তিনি বললেন, “আপনি কি খুলবেন না আমি পুলিশ ডাকব? আপনি যদি বেশী কথা বলেন অথবা চিৎকার করেন তবে, আমাদের নির্দেশ আছে পুলিশ ডাকার। পুলিশেরা নিচে অপেক্ষা করছেন। আপনি খারাপ ব্যবহার করতে পারবেননা। আপনি যদি পরীক্ষা না করাতে চান তবে চলে যান। এটা আপনার ব্যাক্তিগত ব্যাপার, আমার না। কিন্তু চাকরি পেতে হলে এ পরীক্ষা করাতে হবে।”[78]
তুরভি এ. তার মন পরিবর্তন করলেন এবং কাপড় খুলে ফেললেন। কর্মীরা তার পেটে, যৌনাঙ্গে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে জেল লাগালেন। তিনি বলেছেনঃ
ফরেনসিক বিভাগে একটি বড় কম্পিউটার আছে যেখানে তারা বিভিন্ন হরমোন, শিন্মের আকার, অণ্ডকোষ, বীর্য ইত্যাদি পরীক্ষা করেন। তারা সেখানে কি আছে বা নেই তা পরীক্ষা করেন। তাই তারা আমার যৌনাঙ্গে জেল দিয়ে একটি আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা করেন। তারা দেখতে চেয়েছিলেম আমার শিন্ম শক্ত হয় কিনা। যেহেতু আমি একজন হিজড়া, আমার শিন্ম কখনই শক্ত হবে না। আমার যৌনাঙ্গ সাধারণ নয়…..হয়ত তারা মনে করেছে যেহেতু আমরা হিজড়া আমাদের কোনো [শিন্ম] নেই।[79]
লিবনি টি. একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেনঃ
তারা আমাদের একটি রুমে নিয়ে যায় এবং আমার বুকের উপর একটি যন্ত্র চেপে কিছু পরীক্ষা করে। সেখানে একজন মহিলা ছিল। তিনি কম্পিউটারে কিছু করছিলেন…. সেখানে আরও দুইজন মহিলা ও একজন পুরুষ ছিলেন। একজন চিকিৎসক এবং একজন মহিলা সম্ভবত নার্স ছিলেন। আমরা আমাদের কাপড় একটু উপরে তুলেছিলাম কিন্তু তখন একজন মহিলা আমাদের সব কাপড় খুলে ফেলেন। তখন লোকটি জেলের মত কিছু লাগান এবং আমাদের বুকে এবং শরীরের সব অংশে চেপে ধরেন…..এটা করার সময় তিনি বলেছিলেন…. 'আপনি একজন পুরুষ…আপনি যদি ইঞ্জেকশান নেন তাহলে ভাল হয়ে যাবেন। আপনি কেন এটা করছেন [হিজড়া হয়ে আছেন]?’ [80]
পরিক্ষা শেষে আমাদের বেরিয়ে যাবার সময় ছিল আরও লাঞ্ছনাকর। “শেষ পরীক্ষার সময় যখন আমরা রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, ডাক্তাররা আমাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ হেসে যাচ্ছিল। অন্যরা তাদের মুখ ঢাকার চেষ্টা করছিল। কিছু লোকজন আমাদের অপমান করছিল এই বলে যে, ‘আহ, এরা কারা?” রিমা সি. বলেছেন।[81] “আমার কি করা উচিত ছিল? আমি লজ্জায় মাথা নত করে ছিলাম এবং পুরো সময়টা চুপ করে থেকেছি।” তিনি বলেছেন। লিবনি টির. মতে, এই নির্যাতন তার মনে একটি প্রশ্ন তোলে, আদৌ এর বিকল্প আছে কিনা। তৃতীয় পরীক্ষা শেষ হবার পর, একজন ডাক্তার তাকে ইনজেকশন নিয়ে আসল পুরুষ হবার পরামর্শ দেন। তিনি বলেছেন, “আমি জিজ্ঞেস করি, যদি আমি ইঞ্জেকশন নেই, তাহলে কি হবে?”[82]
হাসপাতালে নির্যাতনের পরবর্তী অবস্থা
আমার কারণে পুরো হিজড়া সম্প্রদায়ের সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। তাদের রাগ করার যথেষ্ট কারন ছিল।
-লিবনি টি., [ ঢাকা, অক্টোবর, ২০১৫]
হাসপাতালে অপমানজনক ব্যবহারের পর, হিজড়ারা তাদের নিজ এলাকাতে তাদের সম্প্রদায়ে ফিরে আসে এবং তাদের জীবন পুনরায় শুরু করার চেষ্টা করে।
হাসপাতালের কর্মী থেকে অপমানের এই ঘটনা রিমা সি. এর কানে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। “তারা আমাদের বলেছেঃ আপনারা হিজড়া নন। আপনারা পুরুষ। আপনারা পুরুষ, মিথ্যাভাবে হিজড়াদের ছদ্মবেশ ধরেছেন। আপনাদের পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়া উচিৎ। একটা ইনজেকশন নিলে আপনারা ভাল হয়ে যাবেন।[83]
এত কিছুর পরও তিনি বলেনঃ “আমরা আশা ছাড়িনি। না, আমরা অনেক কিছু সহ্য করেছি। আমাদের এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আমি মাথা উঁচু করে বাঁচতে চাই। হ্যাঁ, আমরা কাজ করতে চাই। আমরা পেছনে পড়ে থাকবনা। তারা আমাদের ঘৃণা করে, কিন্তু আমরা তাদের দেখাতে চাই যে আমরা আমাদের দেশের জন্য কিছু করতে পারি… ।” তুরভি এ. এর মতে, যদিও এ অভিজ্ঞতাটি চরম অবমাননাকর, “আমি ভেবেছিলাম, আমি অন্তত একটা কাজ পাবো এবং কেউ জানবে না…আমি খুশিমনে বাড়ী এসেছিলাম এই ভেবে যে আমরা একটা চাকরি হবে।”[84]
তারপর, চূড়ান্ত পরীক্ষার কয়েক সপ্তাহ পর যারা ঢাকা মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা করাতে গিয়েছিল, ঢাকার বিভিন্ন স্থানীয় পত্রিকায় তাদের ছবি ও ঠিকানা প্রকাশ করা হয়েছে। শিরনাম ছিল যে “১২ জন পুরুষ সরকারি চাকরির লোভে হিজড়ার ছদ্মবেশ ধারণ করে।”[85] “রিমা সি. এই কলামটি প্রথম দেখেন যখন একজন বন্ধু তা ফেইসবুকে প্রকাশ করে।” এখানে বলা হয়েছে যে, আমরা ছদ্মবেশী… এবং আরও নানান রকম অপমানজনক মন্তব্য।[86]
জ্যোতি পি খবর পাবার পর বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। বিক্ষিপ্তভাবে সে হাসপাতালের আশপাশে পদচারণা করতে থাকেন “আমার কোন ধারণা ছিলনা কোথায় যাচ্ছি। আমি শুধু ভাবছিলাম, ডাক্তাররা কি করল? তারা শিক্ষিত মানুষ এবং তারা কি করে এমন করল. . . তারা মানুষ মেরে ফেলতে পারে” সে ভাবছিল: “আমাদের সব সংগ্রামের পরেও মানুষ আমাদের অপমান করবে, আমাদের সর্বস্বান্ত করবে। কিন্তু কেন তারা আমাদের আশা দিয়েছিল এবং তারপর আমাদের অপমান করল? এখন এই খবর ইন্টারনেটে প্রকাশি হয়েছে। এটা এত কঠিন যে আমি ভেবেছিলাম এই বেঁচে থাকার কোন অর্থ নেই।” একটি হিজড়া অধিকার কর্মী জ্যোতিকে বিক্ষিপ্তভাবে হাঁটতে দেখে তাকে রাস্তার পাশে সরিয়ে আনে।[87] পরের কয়েক সপ্তাহেও তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি।
আমি এমনকি আমার ঘর ছেড়ে বের হতে পারিনি। এখন ইন্টারনেট প্রত্যেক বাড়িতে এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এসব খবর পাওয়া যায়। যেই আমাকে দেখত বলত: 'তুমি একজন ছেলে মানুষ। তুমি কেন ভান করছ? 'যখন আমার বাবা মারা গেলেন, আমি এতটা ব্যথা পাইনি যেমন আমি তখন অনুভব করেছি। আমাদের ওরা এভাবে জীবন্ত কবরে পাঠাল?[88]
তিনি আরও বলেনঃ
ডাক্তার বলেছেন, ইনজেকশন নিলে আপনি একজন পুরুষে পরিণত হবেন। আমি বললাম, ইনজেকশন নিয়ে আমি পুরুষ হতে চাই না। আমি মহিলা হতে চাই। আমি হিজড়া হতে চাই। আমি পুরুষ হতে চাই না। আমি পুরুষ নই। আপনি কিভাবে ইনজেকশন দিয়ে আমাকে পুরুষ বানাবেন? তিনি বলেন, না, সব ঠিক হয় যাবে। ইনজেকশন সব ঠিক করে দেবে। এসব কিছুই আপনি করবেন না…তিনি এসব বলে আমাকে হয়রানি শিকার এবং ভয় দেখিয়েছেন। তখন আমি আরও বেশী ভয় পেলাম। তিনি এসব কি বলছেন? এখন পর্যন্ত আমি নিজেকে হিজড়া বলেই জানি এবং আমি হিজড়াদের সাথে থাকি। আমি নিজেকে হিজড়া পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। এখন তিনি জোরগলায় বলছেন যে, ‘না তুমি হিজড়া না।’ সেই মুহূর্তে আমি সত্যিই মানসিক চাপ অনুভব করি এবং ভয় পাই। সে মুহূর্তে আমি আমার সব উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। কি হচ্ছে এসব? এখন পর্যন্ত, আমি বুঝে উঠতে পারিনি আমি কে অথবা কি? আমার সব কথাকে অস্বীকার করে তারা আমাকে আরও বিভ্রান্ত করে দিয়েছেন। আমি আমার হিজড়া পরিচয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি নিজেকে হিজড়া বলে জানি। যেভাবে ডাক্তাররা আমাদের সাথে ব্যবহার করেছেন এবং যা বলেছেন, আমি নিজেকে আর চিনতে পারছিনা। আমি কে? আমি কি একজন পুরুষ অথবা মহিলা অথবা হিজড়া অথবা তারা যে পরিচয় আমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন, তাই আমার আসল পরিচয়? আমি অনেক বিভ্রান্ত ছিলাম।[89]
সাক্ষাৎকার দানকারীরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে কিভাবে “নকল হিজড়া” খবরটির প্রচার হিজড়া সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব ফেলেছে। যারা কর্মসংস্থান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি এবং শারীরিক পরীক্ষা করাননি তারা মনে করেছেন এ ১২ জন হিজড়া পুরো হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে কারণ এ ঘটনা নেতিবাচক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে যা তাদের আয়ের পথ কঠিন করে দিয়েছে। লিবনি টি. এর মতেঃ আমার কারনে পুরো হিজড়া সম্প্রদায়ের সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। যার কারনে তাদের রাগ করার যথেষ্ট কারন রয়েছে। এত সব কিছুর পরে তাদের রাগ করটা আর অস্বাভাবিক নয়। তাই অন্য হিজড়ারা আমাদের কথা শুনিয়েছে এবং রাগের চোটে আমাদের সাথে কাজ করতে অথবা হিজড়া সম্প্রদায়ের সাথে থাকতে নিষেধ করেছে।”[90]
তুরভি এ. এর মতে, ডাক্তার যখন তাকে ডিএমসি তে পরীক্ষা করছিলেনঃ “[ডাক্তার] আমাকে অপমানজনক স্বরে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ ‘আপনি এখানে এসেছেন কেন?’ আমি জবাব দিলাম, ‘কেন? আপনি জানেননা আমি এখানে কেন এসেছি?’ তিনি বললেন, ‘আপনার সব কিছু আছে। আপনার সবকিছু [শারীরিক গঠন] ঠিক আছে। আপনি কেন এখানে এসেছেন? এটা পাগলের লক্ষণ।’”[91] রিমা সি. এর জন্য, এ প্রক্রিয়া চলাকালে যে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, তা হিজড়াদের দৈনন্দিন জীবনের রূঢ় বাস্তবতার প্রতিফলন - এইবার শারীরিক পরীক্ষার নামেঃ “মানুষ আমাদের লাঞ্ছিত করে আর হাসপাতালেও আমরা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি। আমাদের কিসের অধিকার আছে?[92] কিসের স্বীকৃতি? এটা কি ধরনের স্বীকৃতি যা আমাদের প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে?৯২ লিবনি টি. সরকারি চাকরীর জন্য চরম নির্যাতন সহ্য করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, এ ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা তাকেও নাড়িয়ে দেয়ঃ
আমি ভেবেছিলাম সরকারি চাকরির জন্য এই মূল্য পরিশোধ করতে হবে। তাই, সব ধরনের অপমান এবং বাঁধা স্বত্বেও আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম। সবকিছুর পর, তারা আমাদের হিজড়া হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। তার পরিবর্তে, তারা আমাদের বলেছে যে আমরা পুরুষ… তারা মনে করেছিল যে হিজড়াদের স্ত্রীযোনি এবং শিন্ম উভয় ধরনের যৌনাঙ্গ আছে। যা সত্য নয়। আমাদের পরীক্ষা করার আগে, তাদের জানা প্রয়োজন ছিল কিভাবে একজন হিজড়া হয় এবং হিজড়ারা কোথা থেকে আসে…তার পরিবর্তে, তারা আমাদের হয়রানির শিকার করেছে।[93]
আইনগতভাবে লিঙ্গ স্বীকৃতিপ্রদানে সর্বোত্তম পন্থা
আমাদের এভাবে অপমান করার মানে কি? আপনাদের আগে থেকে জানা উচিত ছিল একজন হিজড়া কি। হিজড়ারা পুরুষ না, নারীও না। হিজড়া হিজড়া হয়।
-রিমা সি., [ঢাকা, অক্টোবর ২০১৫]
চিকিৎসা বিজ্ঞান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে এবং লিঙ্গ রূপান্তরের সমর্থন, পদ্ধতি ও চিকিত্সা বিশ্বের কিছু অংশে পাওয়া যায়, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হিজড়াদের জন্য সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে আইনি ও চিকিৎসা প্রক্রিয়া পৃথক রাখা। বিশ্বের অনেক দেশের জাতীয় আইন পর্যায়ক্রমে এই মান বজায় রাখছে।
হিজড়াদের জন্য আইনি স্বীকৃতি প্রক্রিয়ার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে সার্জারীকে গণ্য করা হয়। বিশেষভাবে নির্বীজকরণ, অথবা যৌনাঙ্গ অপসারণ ব্যাপকভাবে সমালোচিত।[94] বৃহত্তর অর্থে, যৌন প্রবৃত্তি ও লৈঙ্গিক পরিচয় সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন প্রয়োগের জন্য যকযাকারতা মূলনীতির ধারা ৩ এ বলা হয়েছে :
আইনের চোখে প্রত্যেকেরই একজন মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আছে। বিভিন্ন যৌন প্রবৃত্তি এবং লৈঙ্গিক পরিচয়ের ব্যক্তি, জীবনের সবক্ষেত্রে আইনি ক্ষমতা ভোগ করার অধিকার রাখে। প্রতিটি ব্যক্তির নিজ যৌন প্রবৃত্তি ও লিঙ্গ পরিচয় তাদের ব্যক্তিত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং আত্ম-পরিচয়, মর্যাদা এবং স্বাধীনতার চিহ্ন। লৈঙ্গিক পরিচয়ের আইনগত স্বীকৃতিদানের শর্ত হিসেবে, কাউকে সার্জারি, নির্বীজন বা হরমোন থেরাপি সহ অন্য কোন চিকিৎসা পদ্ধতির জন্য জোর করা যাবে না। কোনো সামাজিক অবস্থান যেমন বিয়ে অথবা অভিভাবকত্ব, একজন ব্যক্তির লৈঙ্গিক পরিচয়ের আইনগত স্বীকৃতিদান প্রতিরোধ করতে পারবেনা। কেউই তাদের যৌন প্রবৃত্তি বা লিঙ্গ পরিচয় গোপন, দমন, বা অস্বীকার করতে পারবেনা। ৯৫[95]
২০১৫ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ জাতিসঙ্ঘের ১২ টি প্রতিনিধি এক যৌথ বিবৃতিতে তাদের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এর বাধ্যবাধকতা তুলে ধরেছে। “অবমাননাকর শর্ত ছাড়া হিজড়াদের লৈঙ্গিক পরিচয়ের আইনগত স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে।”[96]
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সংস্থা আইনগতভাবে লৈঙ্গিক পরিচয় স্বীকৃতি দানের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতির হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করেছে।
হিজড়াদের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য WPATH, (একটি আন্তর্জাতিক বহমুখী পেশাগত সংস্থা) তথ্য-ভিত্তিক শিক্ষা, গবেষণা, আইনগত অধিকার, এবং হিজড়াদের স্বাস্থ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন প্রচারের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ৭০০ সদস্যদের একত্রিত করেছে, এবং ২০১০ সালের বিবৃতিতে লৈঙ্গিক পরিচয় স্বীকৃতিদানের শর্ত হিসেবে নির্বীজকরনের প্রক্রিয়াটি অপসারণের আহ্বান জানিয়েছে।[97] ডাবলিউপিএইচটিএইচ অনুযায়ীঃ
লৈঙ্গিক পরিচয় স্বীকৃতিদানের শর্ত হিসেবে কোনো ব্যাক্তিকে অস্ত্রপাচার অথবা নির্বীজকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। যদি পরিচয় পত্রে লৈঙ্গিক পরিচয় চিহ্নিতকরনের প্রয়োজন হয়, তবে তা সেই ব্যাক্তির পছন্দসই লিঙ্গ চিহ্নিত করতে হবে, যা তার প্রজনন ক্ষমতার উপর নির্ভর করে না। ডাবলিউপিএইচটিএইচ এর পরিচালনা বোর্ড সরকার ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে লৈঙ্গিক পরিচয় স্বীকৃতিপ্রদানের শর্ত হিসেবে অস্ত্রপাচারকে অপসারণ করার পরামর্শ দান করেছে।[98]
২০১৫ সালে, ডাবলিউপিএইচটিএইচ তাদের বিবৃতি পরিবর্তন করে। তারা জোরপূর্বক নির্বীজকরনের নিন্দা করা ছাড়াও আইনগতভাবে লৈঙ্গিক পরিচয় স্বীকৃতিদানের জন্য অস্ত্রপাচারকে শর্ত হিসেবে গণ্য করার সমালোচনা করে বলে যে, “কোন বিশেষ চিকিৎসা অস্ত্রোপচার অথবা মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা, কারো লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানদণ্ড হতে পারেনা। সেজন্য এগুলো আইনগতভাবে লিঙ্গ রূপান্তরের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হতে পারেনা।”[99]
এশিয়ায় আদালত আইনগতভাবে লৈঙ্গিক পরিচয় স্বীকৃতি প্রক্রিয়ায়, নিম্নবর্ণিত ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে:
- ২০০৭ সালে রায়ে, নেপালের সুপ্রিম কোর্টের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি তৃতীয় লিঙ্গ বিভাগে সংখ্যালঘু হিজড়া ও লিঙ্গে অবিশ্বাসী মানুষ ছাড়া বিভিন্ন পরিচয়ের একটি বিস্তৃত পরিসরের মানুষদের বোঝানো হয়েছে।[100] ২০১৪ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায় যে উত্তরদাতা তাদের লৈঙ্গিক পরিচয়ের জন্য ১৬ টি ভিন্ন বিভাগ উল্লেখ করেছে।[101] আদালত স্পষ্ট করে বলেছে যে কাগজপত্রে এবং সরকারি নিবন্ধনে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি লাভের একমাত্র নির্ণায়ক হচ্ছে একজন ব্যক্তির “স্ব-অনুভূতি।”[102] এ রায় আইনের চোখে স্বীকৃতি লাভের অধিকার আদায়কে সমর্থন করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তির ১৬ নং ধারা এবং যকজাকার্তা নীতিমালার মাধ্যমে।
- ২০১৪ সালে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে বলেছে যে, আইনগতভাবে লিঙ্গ স্বীকৃতিদানের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতির ভেতর দিয়ে যাওয়া জরুরি নয়। কোর্ট বলেছেঃ “কিছু ব্যক্তি তাদের অনুভূত লিঙ্গের সাথে শারীরিক বৈশিষ্ট্যের মিল রাখতে অস্ত্রোপচার এবং অন্যান্য পদ্ধতি গ্রহণ করে যা তাদের অনুভূতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জন্মের সময়ের লিঙ্গের সাথে অনুভূত লিঙ্গ পরিচয়ের মতবিরোধ হওয়ার কারনে কিছু আইনগত ও সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়।” সেখানে আরও বলা হয়েছে, “লিঙ্গ পরিচয়, একজন মানুষকে একজন পুরুষ, নারী, হিজড়া হিসেবে অথবা অন্য পরিচয়ে তার আত্ম-পরিচয় প্রকাশ করে । আদালত স্পষ্ট উল্লেখ করেছে যে আইনগতভাবে লৈঙ্গিক পরিচয় পরিবর্তন করার জন্য বাধ্যতামূলক নির্বীজকরন এবং অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতি আবশ্যকীয় নয়ঃ “আইনগতভাবে লিঙ্গ স্বীকৃতির জন্য কাউকে জোরপূর্বক এসআরএস, চিকিৎসা পদ্ধতি সহ নির্বীজকরন বা হরমোন থেরাপির মধ্য দিয়ে যেতে হবেনা।”[103]
- সালে, দিল্লি হাই কোর্ট আদেশ করে যে, “প্রত্যেকেরই একটি মৌলিক অধিকার রয়েছে তাদের নিজস্ব লিঙ্গে স্বীকৃত হবার” এবং লৈঙ্গিক পরিচয় এবং যৌন প্রবৃত্তি আত্ম-পরিচয়, মর্যাদা ও স্বাধীনতার অধিকার সংরক্ষণ করে।[104]
প্রস্তাবনা
আইন, বিচার মন্ত্রণালয় ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে
• জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করে একটি অধিকার ভিত্তিক আইনি স্বীকৃতির খসড়া তৈরি করা যাতে হিজড়ারা একটি সহজ, স্বচ্ছ, এবং সম্মানজনক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব পরিচয়ে স্বীকৃত হতে পারে। এ প্রক্রিয়াটির সাথে বালি মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য থাকতে হবে, সেইসাথে উপলব্ধি করতে হবে যে “প্রতিটি ব্যক্তির একটি নিজস্ব পরিচয় আছে.....লৈঙ্গিক পরিচয় তাদের ব্যক্তিত্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আত্ম-পরিচয়, মর্যাদা ও স্বাধীনতার প্রতীক।”
• আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষা ও সর্বোত্তম চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে আইনগতভাবে লিঙ্গ শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে হবে এবং এ প্রক্রিয়াকে মেডিকেলের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখার জন্য আহ্বান জানাতে হবে।
• তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দান বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে, প্রত্যেক ব্যাক্তিকে কাগজপত্রে যেমনঃ পাসপোর্ট, পরিচয় পত্র, শিক্ষাগত সার্টিফিকেট ইত্যাদিতে নিজেদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে পরিচয় দেবার সুযোগ দান করতে হবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে
• বিশ্ব হিজড়া স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সংস্থা ও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের চিকিৎসা পাঠ্যক্রম ও হিজড়াদের স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন করতে হবে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্দেশ্যে
• সমাজকল্যাণ বিভাগের সব কর্মী যারা হিজড়াদের সাথে কাজ করবেন, হিজড়া জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে, তাদের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
• একটি বৈধ লিঙ্গ স্বীকৃতিকরণের পদ্ধতি তৈরি করার সময়কালে, ২০১৪ সালে যে ১২ জন হিজড়াকে সরকারী চাকরির জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল এবং যারা তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ হারিয়েছে, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। সেইসাথে নিয়োগকর্তাদের হিজড়া সহকর্মীদের সাথে কাজ করার জন্য সংবেদনশীলতার প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।
কৃতজ্ঞতাস্বীকার
কাইল নাইট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সমকামী, উভকামী এবং হিজড়া অধিকার সংরক্ষণ বিভাগের গবেষক এবং অন্য একজন গবেষক এ প্রতিবেদনটি লিখেছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন।
এ প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করেছেন গ্রেইম রেইড, এলজিবিটি অধিকার বিভাগের পরিচালক, দেদ্রিক লোম্যান, স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার বিভাগের পরিচালক, তেজস্রী থাপা, সরূপ ইজাজ এবং জয়শ্রী বাজোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়ার গবেষকগণ এবং সেইসাথে মীনাক্ষী গাঙ্গুলী, দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক। প্রতিবেদনটির আইনগত পর্যালোচনা করেছেন ক্লাইভ বোল্ডয়িন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ঊর্ধ্বতন আইন উপদেষ্টা, এবং জোসেফ সানডারস, সহকারী পরিচালক। প্রতিবেদনের পূর্ববর্তী সংস্করণ পর্যালোচনা করয়েছেন নিলা ঘোষাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এলজিবিটি অধিকার বিভাগের ঊর্ধ্বতন গবেষক।
অতিরিক্ত সহায়তা করেছেন প্রকাশনা সহযোগী অলিভিয়া হান্টার এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপক ফিতসরয় হেপকিন্স ।