Skip to main content

বাংলাদেশঃ বন্দীদের “পায়ে গুলি চালানো” বন্ধ কর

নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্ত ও পুনর্গঠনের প্রয়োজনে জাতিসংঘকে আমন্ত্রণ জানানো উচিত

(নিউ ইয়র্ক, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৬) - বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে বিরোধীদলীয় সদস্য ও সমর্থকদের পায়ে গুলি চালাচ্ছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত এক রিপোর্টে আজ এমনটি উল্লেখ করা হয়েছে।  পুলিশী হামলার শিকারী এসব ব্যক্তিদের ভাষ্য মতে, পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন সময়ে তাদের গুলি করা হয় এবং পরবর্তীতে তারা মিথ্যাভাবে দাবি করে যে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সশস্ত্র অপরাধীদের সাথে গুলিবিনিময়কালে অথবা তীব্র প্রতিবাদের সময়ে বন্দীদের গুলিবিদ্ধ করা হয়েছিল।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেছেন, “বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বহু আগে থেকেইআটককৃত বন্দীদের  ‘'ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ডের’ নামে এই বলে হত্যা করে আসছে যে, যখন কর্তৃপক্ষ বন্দীকে অপরাধস্থলে নিয়ে গিয়েছিল, তখন তার সঙ্গী কর্তৃপক্ষের উপর হামলা চালায় এবং গোলাগুলি বিনিময়কালে আটককৃত বন্দী মৃত্যুবরণ করে”।  “এখন তারা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির ন্যায় একটি নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে যেখানে গ্রেফতারকৃত বন্দীদের পায়ে গুলি চালানো হয় কারণ তারা বিরোধীদলের সদস্য অথবা সমর্থক।



‘বাঁচার কোনো অধিকার নেই’: বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক বন্দীদের ‘পায়েগুলি ও বিকলাঙ্গ করা’” শীর্ষক ৪৫ পাতার রিপোর্টটি, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে “পায়েগুলি চালানো” ও গুরুতর জখমের সকল ঘটনাগুলোর যথাযথতা প্রমাণের জন্য অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত চালানোর আবেদন করে। সেইসাথে তদন্ত পরিচালনা এবং উপযুক্ত সুপারিশ প্রদান করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার হাই কমিশনার এবং নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূতকে আমন্ত্রণ জানানো; যাতে বিচার ব্যবস্থা, জবাবদিহিতা ও নিরাপত্তা বাহিনীর পুনর্গঠন সুনিশ্চিত করা সম্ভবপর হয়।

রিপোর্টটি ২৫ জন বাক্তির সাক্ষ্য অন্তর্ভুক্ত করে, যাতে বেশীরভাগই বিরোধীদল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি ) এবং জামাত-ই-ইসলামীর সদস্য ও সমর্থক, যারা বলেছে যে পুলিশ তাদের পায়ে গুলি করে কোনোরকম প্ররোচনা ছাড়া। গুলিবিদ্ধের শিকার কিছু মানুষ চিরতরে পঙ্গু হয়ে যায়, আবার কিছু মানুষের পা কেটে ফেলে দিতে হয়। অনেকেই গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে প্রচণ্ড মার খাবার কথা উল্লেখ করেছেন।

নির্বিচারে গ্রেফতার, নিখোঁজ, নির্যাতন অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ভয়ে, আহতদের অধিকাংশ তাদের পরিচয় প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায়- যা বাংলাদেশে একটি সাধারণ ঘটনা, বিশেষত তারা যদি বিরোধীদলের সমর্থক হয়। অন্যরা আইনগত শাস্তির আশংকা করে, অধিকাংশ ফৌজদারি মামলার সম্মুখীন হয়। দুটি ক্ষেত্রে প্রচার মাধ্যমের সদস্যরা নির্যাতনের শিকার হন, তারা রিপোর্টে নিজেদের পরিচয় প্রকাশে সম্মতি জানান। মাহবুব কবির, জামাতপন্থী পত্রিকা-নয়া দিগন্তের মার্কেটিং বিভাগের কর্মী, যিনি পুলিশ কর্তৃক আটক এবং একজন সাক্ষীর সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, পরবর্তিতে পুলিশ তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে। মাহবুব কবিরের মতে, যে পুলিশ অফিসার তাকে গুলিবিদ্ধ করেন, তিনিই(পুলিশ) পরে তাকে হুমকি দেন যে, "আমি তোমার পায়ে গুলি করেছি, তুমি যদি আমার বিরুদ্ধে কিছু বল, তাহলে পরেরবার আমি তোমার চোখে গুলি করব"।

আকরাম (ছদ্মনাম ), ৩২ বছর বয়সের একজন কৃষক, বলেছেন যে চট্টগ্রামে রেইডের পর একজন পুলিশ অফিসার ইচ্ছাকৃতভাবে তার পায়ে গুলি চালায়ঃ "আমাকে কিছু সময় মারধর করার পর, পুলিশ আমাকে গাছের সাথে বেঁধে রাখে। তারপর [একজন পুলিশ অফিসার] আমার বাম পায়ের হাঁটুর উপরে গুলি চালায়। সেই পুলিশ অফিসার সব অভিযোগ অস্বীকার করে বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংস্থাকে বলেছেন যে, আকরামের মত ভয়ংকর অপরাধীর "বাঁচার কোন অধিকার নেই"। তার কিছু মাস পরে, অন্য একজন সন্দেহভাজন আসামীকে অস্ত্র বিনিময়কালে গুলি করার কথা স্বীকার করে, তিনি বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যার কথা স্বীকার করেছেন এই বলে যে, "সে [আসামী] এখনও বেঁচে আছে কারন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। যদি র‍্যযাব [র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটলিয়ন] অথবা অন্য কোন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাকে ধরত, সে এতক্ষণে মৃত থাকত”।

অ্যাডামস বলেন "প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন যে বিচার বহির্ভূত হত্যা অথবা সহিংসতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান "শুন্য সহনশীল", কিন্তু এ নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে ২০০৯ সাল থেকে, যখন তিনি ক্ষমতায় এসেছেন  - যা আপাতদৃষ্টিতে প্রমাণ করে, তাঁর সরকার রাষ্ট্র অনুমোদিত সহিংসতার প্রতি পূর্ণমাত্রায় সহনশীল"



২০১৩ সালের প্রথম দিকে সহিংস প্রতিবাদের পর, "পায়ে গুলি চালানোর" এ প্রথা  শুরু হয় । আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আই সি টি), ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দেলোয়ার  হোসেন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে, যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। জানুয়ারি, ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে আবার সহিংসতা শুরু হয় যখন বিরোধীদলীয় সমর্থকেরা হরতাল ও অবরোধ সফল করার জন্য জনসাধারণের উপর পেট্রল বোমা ব্যবহার করে  । নিরাপত্তাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ, তাদের লক্ষ্য ছিল বিক্ষোভকারী ও আশেপাশের জনসাধারণ। সেসময় থেকে আজ পর্যন্ত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহু গ্রেফতার, নির্যাতন, নিখোঁজ ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তথ্য ধারণ করে।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বাংলাদেশ সরকার "পায়ে গুলি চালানোর" এ পন্থা অবলম্বন করেছে জনসাধারণকে রাজপথে প্রতিবাদে বাঁধা দেয়ার জন্য।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকে সহিংসতা ও বিক্ষোভ প্রতিরোধের জন্য। কিন্তু, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলাও তাদের অন্যতম দায়িত্ব। কোন ব্যাক্তির অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নিরাপরাধ ধরে নেয়া, তাকে নির্যাতন না করা, এবং মামলার নিষ্পত্তির জন্য তাকে আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনাল দ্বারা একটি নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ শুনানির যোগ্য ভেবে সেসব সুনিশ্চিত করতে বাংলাদেশ বাধ্য। পুলিশ আটককৃত বন্দীদের গুলিবিদ্ধ করেছে আত্মরক্ষার জন্যে অথবা সহিংস প্রতিবাদে গোলাগুলি বিনিময়কালে, এসকল অভিযোগগুলো সমর্থন অথবা প্রত্যাখ্যান করার অবস্থানে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নেই, সকল ঘটনাগুলো সন্দেহের উদ্রেক ও স্বাধীনভাবে তদন্তের যোগ্য, এবং প্রয়োজনবোধে দোষী পুলিশ অফিসার এবং তাদের আদেশ দাতাদের বিচারের কাঁঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

"এ অভিযোগগুলো চরমভাবে অস্বীকার করার পরিবর্তে, সরকারের উচিত জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করাএবং দোষী ব্যাক্তিদের বিচারের আওতায় আনা সুনিশ্চিত করা", অ্যাডামস বলেছেন। "শেখ হাসিনা এটা স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে শুধুমাত্র ভুল রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়ায় কারনে বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী সাধারণ নাগরিকদের হত্যা ও পঙ্গু করে পার পাবে না।"

নির্বাচিত অংশবিশেষ
"পুলিশের একজন সদস্য তার মুঠোফোনে কথা বলছিল এবং অপরপাশে অন্য একজনকে জিজ্ঞেস করছিল আমাকে কি তাদের আহত করা উচিত অথবা মেরে ফেলা উচিত। তার কথা বলে শেষ হলে, অন্য একজন পুলিশ অফিসার আমাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয় এবং আমার বাম পায়ে গুলি করে। তখন তারা আবার আমাকে ভ্যানের পেছনে রাখে এবং হাসপাতালে নিয়ে যায়।
- আলম, ৩৫, গুলিবিদ্ধ হন সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সালে 

আমি শুধু মার বন্ধ করার জন্যে, আমার দুজন বন্ধুর নাম বলেছি। তারপর তারা আমাকে একটি মাঠে নিয়ে যায় এবং আমার চোখে কাপড় বেঁধে দেয়। আমার কোনো ধারণা ছিল না যে তারা কি করছিল এবং আমি চিৎকার করছিলাম।তারা আমাকে  ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয় এবং তারপর আমাকে গুলি করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।  আমি তাদের একজনকে বলতে শুনেছি, "আবার গুলি করো"। তখন অন্য একজন বলেছিল, "কোনো প্রয়োজন নেই"।
-হায়দার, ২০, গুলিবিদ্ধ হন মার্চ, ২০১৫ সালে

একজন পুলিশ সদস্য আমার হাতে হাতকড়া পরায়, বাইরে নিয়ে আসে এবং দাঁড় করিয়ে রাখে। সে তখন আমার পেছনে যায় এবং আমার বাম পায়ে গুলি করে। আমি সম্ভবত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, কারণ পরে চোখ খোলার পর আমি নিজেকে  ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রমাটোলজি এবং অর্থোপেডিক রিহ্যাবিলিটেশন এর বিছানায় পাই। চারদিন পর আমার বাম পা কেটে ফেলে দিতে হয়।
- আনিস, ৪৫, গুলিবিদ্ধ হন ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সালে

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country
Topic