(নিউ ইয়র্ক) – জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অপারেশন (ডিপার্টমেন্ট অব পিস অপারেশন) বিষয়ক বিভাগের উচিত বাংলাদেশের কুখ্যাত অত্যাচারী অর্ধসামরিক র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-কে জাতিসংঘে মোতায়েন থেকে নিষিদ্ধ করা, আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল জিন-পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের কাছে ১২ টি সংস্থার পাঠানো একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, যা আজ প্রকাশ করা হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো র্যাবের ব্যাপক নির্যাতনসমূহ নথিভুক্ত করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা এই ইউনিটের সদস্যদের নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম, এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। শান্তিরক্ষা অপারেশন বিভাগ দুই মাস আগে ৮ই নভেম্বর, ২০২১-এ গোপনীয়ভাবে পাঠানো চিঠিটির প্রতি এখনও কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
“মহাসচিব গুতেরেস যদি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের দ্বারা মানবাধিকারের অবমাননার অবসানের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে থাকেন, তবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)- এর মত যে ইউনিটগুলোর বিরুদ্ধে অত্যাচারের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে তাদেরকে তিনি মিশনে মোতায়েন করা থেকে বাদ দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করবেন,” বলেছেন কেরি কেনেডি, রবার্ট এফ কেনেডি হিউমান রাইটস এর প্রেসিডেন্ট। “প্রমাণ গুলো স্পষ্ট; এখন জাতিসংঘের সময় হয়েছে এটি বন্ধ করার।"
ডিসেম্বরের ১০ তারিখে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টেবিলিটি আইনের অধীনে র্যাব-কে একটি "বিদেশী সত্ত্বা যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী বা জড়িত" হিসাবে মনোনীত করেছে ৷
সংস্কারের দিকে পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে, বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণায় মানবাধিকার রক্ষাকারীদের এবং ভুক্তভোগীদের পরিবারের বিরুদ্ধে অস্বীকৃতি এবং প্রতিশোধমূলক আচরণের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জোড়পূর্বক গুম হওয়া ভুক্তভুগীদের পরিবার অভিযোগ করে বলেছে যে কর্মকর্তারা তাদের বাড়িতে হাজির হয়েছে, তাদের হুম্কি দেয়া হচ্ছে এবং তাদের মিথ্যা জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হচ্ছে এই বলে যে তাদের পরিবারের সদস্যকে জোর করে গুম করা হয়নি এবং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছে।
ডিসেম্বরের ৫ তারিখে, জোড়পূর্বক এবং অনিচ্ছাকৃত গুম নিয়ে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে যে,” মানবাধিকার লঙ্ঘনের কমিশনে র্যাব-এর সদস্যদের তাদের কোনো পূর্ববর্তী অভিযোগের প্রেক্ষিতে জড়িত থাকার বিরুদ্ধে তদন্ত না থাকলে অথবা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষার মাধ্যমে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমগুলিতে অংশগ্রহণে যোগ্য হবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ আরও বলেছে যে নির্যাতনের সাথে জড়িত বা প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছুক কর্মকর্তাদের "বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর মধ্যে পদোন্নতি এবং পুরস্কৃত হতে দেখা যাচ্ছে।"
২০২১ সালের মার্চ মাসে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বলেছিলেন যে “র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন দ্বারা নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহারের অভিযোগ একটি দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগ।“ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কনভেনশনের অধীনে বাংলাদেশের ২০১৯ সালের দায়বদ্ধতার পর্যালোচনার সময় এটির সমাপনী পর্যবেক্ষণে, নির্যাতনের বিরুদ্ধে কর্মরত কমিটি বলেছে যে "র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সাথে কাজ করা সদস্যরা প্রায়শই জাতিসংঘের শান্তি মিশনের সাথে সেবা প্রদানের জন্য মোতায়েন করা হয়েছে এমন প্রতিবেদনে তাঁরা উদ্বিগ্ন।“
নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কমিটি সুপারিশ করেছে যে বাংলাদেশ সরকার "জাতিসংঘ শান্তি মিশনে মোতায়েনের জন্য প্রস্তাবিত সকল সামরিক ও পুলিশ সদস্যদের জন্য জাতিসংঘের যথাযথ নির্দেশনা সহ একটি স্বাধীন যাচাই পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করবে এবং এবং নিশ্চিত করবে যে নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম বা অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত কোনো ব্যক্তি বা ইউনিটকে সেবা প্রদানের জন্য নির্বাচিত করা হবে না।"
যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সাতজন বর্তমান বা প্রাক্তন কর্মকর্তার উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, যাদের মধ্যে দেশটির পুলিশ প্রধান, বেনজীর আহমেদ রয়েছেন, যার জাতিসংঘে কর্মরত থাকার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আহমেদ ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন - এমন একটি সময়কাল যখন তার নির্দেশাধীন কর্মকর্তাদের দ্বারা ১৩৬ টি বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড এবং ১০ টি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা রয়েছে। এই সময়ে, জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার-সেক্রেটারি-জেনারেল হার্ভেল্যাডসাস তাকে "জাতিসংঘের পুলিশ বিভাগের কার্যাবলী, কাঠামো এবং ক্ষমতার বাহ্যিক পর্যালোচনার জন্য একটি স্বাধীন পর্যালোচনা দলের একজন বিশেষজ্ঞ সদস্য হিসেবে নিযুক্ত করেন।“
একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে, আহমেদ বলেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাগুলি "ভুল এবং বানোয়াট মিথ্যার" উপর ভিত্তি করে ছিল এবং এর সাথে যোগ করে বলেন যে লোকজন যারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা থেকে র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছিল তারা "আমাদের সরকার এবং আমাদের দেশকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে৷” যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় র্যাবের উপ-প্রধান (ডেপুটি চীফ) কে এম আজাদ বলেন, কোনো অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, তাহলে দেশের স্বার্থে এই মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।“
“শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে র্যাবের সদস্যদের মোতায়েন একটি বার্তাকে শক্তিশালী করে যে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী একজন ব্যাক্তিকে জাতিসংঘের পতাকা তলে সেবা প্রদান থেকে বিরত করবে না এবং জাতিসংঘের মিশনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা অবস্থায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিবে,“ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জাতিসংঘের পরিচালক লুইস চারবন্যে বলেছেন। “জাতিসংঘের উচিত হোস্ট এবং সৈন্য-প্রদানকারী দেশগুলোকে একটি স্পষ্ট সংকেত পাঠানো যে নির্যাতনকারী ইউনিটসমূহ জাতিসংঘের মিশনে অংশ হতে পারবে না।“
চিঠিতে স্বাক্ষর প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হলোঃ
১ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল
২ এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স (এএফএডি)
৩ এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলপমেন্ট (ফোরাম-এশিয়া)
৪ এশিয়ান হিউম্যন রাইটস কমিশন
৫ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এএনএফআরইএল)
৬ ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট
৭ সিভিকাসঃ ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন
৮ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
৯ ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস
১০ রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস
১১ দ্য অ্যাডভোকেটস ফর হিউম্যান রাইটস
১২ ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার