(ব্যাংকক) – মিয়ানমারেরপশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের একটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, আরাকান আর্মি, জাতিগত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং গুরুতর নির্যাতন চালিয়েছে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ জানিয়েছে।
রাজ্যে আরাকান আর্মির আঞ্চলিক বিজয়ের সাথে সাথে রোহিঙ্গাদের উপর চলাচলের বিধিনিষেধ, লুটপাট, নির্বিচারে আটক, দুর্ব্যবহার, এবং বেআইনিভাবে জোরপূর্বক শ্রম ও নিয়োগের মতো অন্যান্য নির্যাতন করা হয়েছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত বৈষম্যমূলক অপরাধসহ নৃশংস অপরাধ করে আসছে।
“আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের উপর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর দীর্ঘদিনের নিপীড়নমূলক নীতির মতোই নীতি প্রয়োগ করছে,” হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক, ইলেন পিয়ারসন বলেন। তিনি আরও বলেন, “আরাকান আর্মির উচিত তাদের বৈষম্যমূলক ও নিপীড়নমূলক কার্যক্রম বন্ধ করা এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা।”
২০২৩ সালের নভেম্বরে যুদ্ধ পুনরায় শুরু হওয়ার পর, আরাকান আর্মি মিয়ানমারের নিপীড়নমূলক সামরিক জান্তার কাছ থেকে দখল করা এলাকায় অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত শাসনের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মি এবং এর রাজনৈতিক শাখা, ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকানের অধীনে জীবনকে কঠোর ও সীমাবদ্ধ বলে বর্ণনা করেছে, যেখানে বৈষম্যমূলক নিয়মকানুন ও চর্চা বিদ্যমান।
২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১২ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে, যারা উত্তর রাখাইন রাজ্যের বুথিডাং টাউনশিপ থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
“আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে জীবন ছিল অবিশ্বাস্যভাবে সীমাবদ্ধ,” জুন মাসে বাংলাদেশে আসা ৬২ বছর বয়সী একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেছেন। “অনুমতি ছাড়া আমাদের কাজ করা, মাছ ধরা, চাষ করা বা এমনকি চলাচল করারও অনুমতি ছিল না। আমরা চরম খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়েছিলাম, বেশিরভাগ মানুষ একে অপরের কাছে ভিক্ষা করত।”
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে আটকা পড়েছে, উভয় বাহিনীই গুরুতর নির্যাতন চালাচ্ছে, যার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক অগ্নিসংযোগ এবং বেআইনি নিয়োগ অন্তর্ভুক্ত। ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে, রাখাইন এবং চিন রাজ্যে ৪ লক্ষেরও বেশি মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, আর ২ লক্ষের মতো মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।
আরেকজন ৬২ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ব্যক্তি বলেছেন যে গত এক বছরে তাকে তার স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ পাঁচবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। “এই সময়ে জীবন ছিল অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন,” তিনি বলেন। “গ্রামগুলির মধ্যে যাতায়াত সীমাবদ্ধ ছিল, এবং অনুমতিপত্র প্রয়োজন ছিল যা খুব কমই দেওয়া হতো।”
রোহিঙ্গা গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন যে বুথিডাং-এর গ্রামগুলির মধ্যে যাতায়াতের অনুমতিপত্র, যা শুধুমাত্র একদিনের জন্য বৈধ, সেটির জন্য ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ কিয়াত (১.৪০ ডলার - ২.৪০ ডলার) খরচ হয় এবং এর জন্য স্থানীয় মুসলিম প্রশাসক এবং আরাকান আর্মি বা এর রাজনৈতিক শাখার স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। তারা আরও জানান, আরাকান আর্মি কারফিউ জারি করেছে। ওই ব্যক্তি বলেন, “যদি তারা কাউকে বাড়ির বাইরে দেখতে পেত, তাহলে তাদের গ্রেপ্তার করা হতো। এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য অজানা হয়ে যেত।”
জীবিকা এবং কৃষিতে আরাকান আর্মির বিধিনিষেধ, সেইসাথে চাঁদাবাজি এবং অত্যধিক দামের কারণে, মারাত্মক খাদ্য সংকট এবং ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে জান্তার ত্রাণ অবরোধ আরও বেড়েছে। কিছু রোহিঙ্গা বলেছেন যে তারা বিদেশে থাকা আত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা পাওয়া পরিবারের কাছে ভিক্ষা করে বেঁচে ছিলেন। অন্যরা খুব সামান্য বা কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই দিনমজুর হিসেবে কাজ করত।
“আমাদের জীবন বাঁচাতে সংগ্রাম করতে হয়েছে,” মে মাসে বাংলাদেশে আসা ষাটোর্ধ্ব আরেক রোহিঙ্গা ব্যক্তি বলেন। “আমি একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করতাম, আরাকান আর্মি যে কোনো কাজ দিত…। প্রথমে তারা আমাদের অর্ধেক পারিশ্রমিক দিত, কিন্তু পরে তারা একেবারে দেওয়া বন্ধ করে দেয়।”
রোহিঙ্গা গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন যে আরাকান আর্মি কৃষিজমি, বাড়িঘর, গবাদি পশু, মাছ ধরা, জ্বালানি কাঠ এবং এমনকি কবরস্থানও দখল করে নিয়েছে। বুথিডাং টাউনশিপের কিন তাউং-এর দুইজন ব্যক্তি বলেছেন যে আরাকান আর্মি মে মাসে তাদের কবরস্থান ভেঙে দিয়েছে এবং তাদের ধানক্ষেত কবর দেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে বলেছে।
আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এবং অন্যান্য রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি, যারা ২০২৪ সালে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিল, তারা আবার উত্তর রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে সংঘর্ষে যোদ্ধা মোতায়েন করছে। এই যুদ্ধ এবং আরাকান আর্মির রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক নিয়োগ মূলত মুসলিম রোহিঙ্গা এবং বৌদ্ধ রাখাইনদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়েছে।
তিনজন রোহিঙ্গা বলেছেন যে তারা তাদের ছেলেদের, যাদের মধ্যে শিশুরাও আছে, আরাকান আর্মির জোরপূর্বক নিয়োগ থেকে রক্ষা করার জন্য পালিয়েছে। একজন ৫৭ বছর বয়সী রোহিঙ্গা শরণার্থী তার পরিবারের সাথে জুন মাসে বাংলাদেশে এসেছেন, যখন আরাকান আর্মি তার ১৭ বছর বয়সী ছেলেকে খুঁজতে শুরু করে। তিনি বলেন, “আমাকে দুই মাস ধরে তাকে বিভিন্ন গ্রামে লুকিয়ে রাখতে হয়েছিল।”
৬২ বছর বয়সী একজন ব্যক্তি বলেন যে তার ছেলেকে এপ্রিল মাসে কিন তাউং গ্রামের প্রশাসক নিয়োগের জন্য নির্বাচন করেন। “তারা তাকে জোর করে যোগ দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করায় আমি সবসময় ভয়ে থাকতাম,” তিনি বলেন। “তারা দরিদ্র পরিবারের শিশুদের লক্ষ্য করে। আমার ছেলে নিয়োগের ভয়ে ভীত হয়ে ৪৫ দিন আগে গ্রাম থেকে পালিয়ে যায়। সে তখন থেকেই নিখোঁজ।”
আরাকান আর্মি তার ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে এবং আরও দুইজনের সাথে ৩৫ দিন আটকে রাখে। “তারা আমাকে অবিরাম মারধর করত,” তিনি বলেন। “আমি শুধুমাত্র আমার ছেলেকে তাদের কাছে এনে দেব বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর মুক্তি পাই।” যখন তিনি পালিয়ে যান, তখন আরাকান আর্মি তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, তার কাছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
আরাকান আর্মি যাদের এআরএসএ বা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সাথে কাজ করার সন্দেহ করে, তাদের প্রতি মারাত্মক দুর্ব্যবহার করেছে। তারা ডিসেম্বর ২০২৪ সালে কেয়া জিংগা পারা গ্রাম থেকে এক ৩৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। “তারা আমার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর সাথে কাজ করার এবং সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের অভিযোগ তোলে, যা আমি করিনি,” তিনি বলেন। “আমাকে বুথিডং শহরে নিয়ে যাওয়া হয়, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের থানায়। তারা প্রায়ই বাঁশের লাঠি দিয়ে আমাকে মারাত্মকভাবে মারধর করত। আমার এখনও হাঁটতে সমস্যা হয়।”
একজন ১৯ বছর বয়সী রোহিঙ্গা যুবক ২০২৪ সালের মে মাসে ন ইয়ত চং গ্রাম থেকে বেআইনিভাবে জোরপূর্বক শ্রমের জন্য অপহরণ হওয়ার পর পাঁচ মাস আরাকান আর্মির সাথে ছিল। সে জানায়, রোহিঙ্গাদের প্রায়শই “মানব ঢাল” হিসেবে যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে পাঠানো হতো। “যদি কেউ প্রতিরোধ করত, তাদের মারধর করা হতো এবং উপহাস করা হতো,” সে বলেন। “আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে আমাদের সাথে সমান আচরণ করা হবে কিনা। তারা বলেছিল যে তারা আমাদের [জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠ] বর্মীয়দের মতো আচরণ করবে এবং মুসলিমদের জন্য অবমাননাকর শব্দ ‘বাঙ্গালী কালার’ বলে ডাকত।”
প্রযোজ্য আন্তর্জাতিক মানবিক আইন, বিশেষ করে ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের সাধারণ ৩ ধারা এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, বন্দীদের নির্যাতন ও অন্যান্য দুর্ব্যবহার, লুটপাট, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশুদের নিয়োগ এবং বিপজ্জনক জোরপূর্বক শ্রমের মতো অন্যান্য নির্যাতন নিষিদ্ধ।
২০২৪ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশ ক্যাম্পে ১২০,০০০ নতুন আগতদের নিবন্ধন করেছে, যখন আরও হাজার হাজার অনিবন্ধিত রয়ে গেছে। নতুন আগতরা জানিয়েছেন যে তারা কোনো সরকারি ত্রাণ বা সহায়তা পাননি। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ মনে করে যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর জোর দেওয়া উচিত যে নিরাপদ, টেকসই এবং সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের জন্য বর্তমানে কোনো পরিস্থিতি বিদ্যমান নেই।
“দাতা সংস্থা এবং প্রভাবশালী সরকারগুলোর উচিত রোহিঙ্গা জনগণকে রক্ষা করার জন্য আরও অনেক কিছু করা, যার মধ্যে মিয়ানমার বা বাংলাদেশে তাদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার অধিকার অন্তর্ভুক্ত,” পিয়ারসন বলেন। তাদের আরাকান আর্মির উপরও চাপ দেওয়া উচিত যাতে তারা রাখাইন রাজ্যের সকল সম্প্রদায়ের অধিকারকে সম্মান করে।”