(নিউ ইয়র্ক) — হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ বলেছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে ভাসান চরের পলি দ্বীপ থেকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলিতে কমপক্ষে ৩৩ শিশুসহ, প্রায় ৩০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের পরিবারের কাছে সরিয়ে নেওয়া উচিত। প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের ভাসান চরে আটক শরণার্থীদের সুরক্ষা সেবা এবং সহায়তা দেওয়ার অনুমতি দেয়নি যারা বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে সমুদ্রে আটক ছিল।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল যে উদ্ধারকৃত শরণার্থীদের ঘনবসতিপূর্ন শিবিরগুলোতে কোভিড -১৯ এর বিস্তার থেকে রক্ষার জন্য ভাসান চরে অস্থায়ীভাবে পৃথক করা [কোয়ারেন্টাইন] প্রয়োজন। তবে, প্রায় দুই মাসেরও পরে, চলতি বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও ঝড়ের ঝুঁকি নিয়ে শরণার্থীরা দ্বীপে অবস্থান করছেন, যদিও জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল আন্তোনিও গুতেরেস এবং মানবিক সহায়তা কাজে বিশেষজ্ঞরা তাদের নিরাপদে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
“যেখানে তাদের পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে প্রার্থনা করছে তাদের ফিরে আসার, বাংলাদেশ কর্ত্পক্ষ সেখানে শরনার্থীদের মন্থন বর্ষায় সাগরের মাঝে এক টুকরো জমিতে তাদেরকে মহামারীর অজুহাতে আটকে রেখেছে,” বলেছেন এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস। “সরকার সহায়তা কর্মীদের শরণার্থীদের দ্রুত সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রবেশাধিকারে অস্বাভাবিকভাবে বিলম্ব করছে, এবং কক্সবাজারে তাদের পরিবারের সাথে মিলিত হবার ক্ষেত্র প্রত্যাখান করছে।“
কক্সবাজারের পরিবারগুলো হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে যে ভাসান চরে স্বজনদের চলাফেরার স্বাধীনতা বা পর্যাপ্ত খাবার অথবা চিকিত্সা যত্নের নিশ্চয়তা ছাড়াই আটক করে রাখা হয়েছে এবং সেখানে নিরাপদ পানীয় জলের তীব্র সংকটে পড়েছে। কিছু শরণার্থী অভিযোগ করেছেন যে এই দ্বীপে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাদের মারধর ও দুর্ব্যবহার করেছে।
কক্সবাজারের কয়েকটি পরিবার বলেছিল যে, শিবিরের নেতারা তাদের বলেছিলেন, তারা যদি তাদের পরিবারের সদস্যদের দেখতে চায় তবে তাদের অবশ্যই দ্বীপে তাদের সাথে যোগ দিতে হবে। কক্সবাজারের এক শরণার্থী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছিলেন যে তাঁর শিবিরের একজন নেতা এসে তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন, এবং বলেছিলেন যে তাঁর ছেলে ভাসান চরে থাকার কারণে তাদের এটির প্রয়োজন হয়েছিল। "তাদের একজন আমার আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন যে আমার ছেলের সাথে যোগ দিতে আমার সেখানে যেতে হবে।" তিনি বলেন।
তবে ভাসান চরে যাওয়া, এমনকি তার ছেলেকে দেখার বিষয়ে তাঁর গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে। "যখন আমি আমার ছেলের সাথে শেষবার কথা বলতে পেরেছিলাম তখন সে সেখানকার সবকিছু সম্পর্কে অভিযোগ করেছিল," তিনি বলেছিলেন। “যদি আমাদের সেখানে স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হয় তবে আমার আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। এমনকি আমার ছেলে আমাকে বলেছিল যে কোনও মূল্যে তাদের প্রস্তাবে রাজি না হতে। ”
ভাসান চরে স্থানান্তরিত হওয়ার বিষয়ে শরনার্থীদের আশঙ্কা সুপ্রতিষ্ঠিত। মানবিক সহায়তাকারী বিশেষজ্ঞরা দ্বীপের বসবাস করার যোগ্যতা এবং সেখানে বসবাসরত শরণার্থীদের চলাচল এবং খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সেবা এবং শিক্ষার স্বাধীনতা অর্জন করবে কিনা তা নিয়ে বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন মিয়ানমার সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ দূত (রিপোর্টেয়ার) ইয়াঙ্গি লি যখন দ্বীপটি পরিদর্শন করেছিলেন, তখন তিনি প্রশ্ন করেছিলেন যে এই দ্বীপটি "সত্যই বসবাসযোগ্য" কিনা।
এই উদ্বেগের মধ্যে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বারবারই বলেছে যে, কোনো শরনার্থীকে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভাসানচরে স্থানান্তরিত হবে না, এবং সরকার জাতিসংঘের সংস্থাগুলো ও স্বতন্ত্র প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে "সবুজ সংকেত" পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সেক্রেটারি শাহ কামাল গত ৩০ অক্টোবর, ২০১৯ গনমাধ্যমকে বলেন যে, “জাতিসংঘের সংস্থাগুলাও দ্বীপের নিরাপত্তাজনিত ইস্যুগুলোর বিষয়ে একটি প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন করবে এবং আমরা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর ছাড়পত্র (Clearance) ব্যতীত স্থানান্তর শুরু করব না।
তবে সরকার শরণার্থীদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে, সুরক্ষা, চিকিৎসা ও পরীক্ষা সুবিধা দিতে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে শরনার্থী পরিদর্শনে বাধা প্রদান করে এবং জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে দ্বীপের মধ্যে এটির বসবাস যোগ্যতার স্বচ্ছ মূল্যায়ন পরিচালনা করতে অস্বীকারের মাধ্যমে এই প্রতিশ্রুতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
শরণার্থীদের ভাসানচরে সরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশের পদক্ষেপ, সরকারের অবস্থানের একটি বিপজ্জনক পরিবর্তন হতে পারে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে । দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রী, এনামুর রহমান ফেব্রুয়ারিতে রয়টার্সকে বলেছেন যে, "আমরা এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেইনি, তবে আমরা তাদেরকে [ভাসানচরে] সড়ানোর ব্যাপারে আর আগ্রহী নই" এবং তিনি আরো বলেন যে সরকার "নিরাপদ, সম্মানজনক এবং উপযুক্ত প্রত্যাবাসনের" জন্য চীন এবং মায়ানমারের সাথে কাজ করতে আগ্রহী।“
ইতোমধ্যে, মায়ানমার এখনো নিরাপদ ও সেচ্ছায় শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের কোনো উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। দাতাগোষ্টী এবং সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর জোড় দেয়া উচিত যেন মায়ানমার সরকার এবং সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা এবং মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে, আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা কাজে নিয়জিত সংস্থাগুলিকে সম্পদ ও অধিকার সংরক্ষণের জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে, এবং রোহিঙ্গাদের জন্য সকল অধিকার এবং সুরক্ষা সহ পুরো নাগরিকত্ব প্রদান করে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে।
"ভাসান চরের শরণার্থী নিরাপদ ও সুস্থ থাকার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের যে আশ্বাস তার মানে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের উচিত এই দ্বীপে সুরক্ষা এবং মৌলিক পরিষেবাদি সরবরাহ করার জন্য জাতিসংঘের নিরবচ্ছিন্ন প্রবেশাধিকার দেয়া এবং দীর্ঘ দিন ধরে বিলম্বিত প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন করতে দেয়া" অ্যাডামস বলেছেন। “যদিও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে নির্মমভাবে শরণার্থীদের জীবনকে অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে রাখা উচিত নয়, তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দায় স্বীকার করার জন্য মিয়ানমারের উপর চাপ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারদের আরও বেশি কাজ করা উচিত।“