Skip to main content

বাংলাদেশ: গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্কার প্রয়োজন

স্থায়ী পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জাতিসংঘের সমর্থনকে স্বাগত জানানো উচিত

বাংলাদেশিরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক মাস উৎযাপন করছে এবং তার স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভের সময় যারা প্রাণ হারিয়েছিলেন তাদের স্মরণ করছে, ঢাকা, ৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪। © 2024 Md. Rakibul Hasan Rafiu/NurPhoto via AP
  • ২০২৪ সালের আগস্টে গণবিক্ষোভের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বাংলাদেশে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার দীর্ঘস্থায়ী সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেয়।

  • ভবিষ্যতের সরকারগুলির যেকোনো দমন-পীড়ন সহ্য করতে সক্ষম এমন দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কষ্টার্জিত অগ্রগতি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যেতে পারে।
  • অন্তবর্তীকালীন সরকারের উচিত মার্চ মাসে মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব আনা যাতে অব্যাহত ভাবে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন তৈরি করা যায় সংস্কারের প্রক্রিয়াকে সহযোগীতা করার জন্য এবং দাতা সরকারগুলির উচিত মূল কাঠামোগত সংস্কারের উপর জোর দেওয়া।

(ঢাকা) – একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন এবং জবাবদিহিতার দিকে এগিয়ে এসেছে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনা দীর্ঘমেয়াদী পদ্ধতিগত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাকে জোর দেয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলে।

মনসুন  বিপ্লবের পর: বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা খাত সংস্কারের একটি রোডম্যাপ” শীর্ষক ৫০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী প্রশাসন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পদ্ধতিগত সংস্কারের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আইনগত ভাবে আটক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা এবং সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত আইন বাতিল করার আহ্বান জানানো হয়েছে। সংস্কারগুলি ক্ষমতা ব্যবস্থাকে পৃথকীকরণ এবং সিভিল সার্ভিস, পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং বিচার বিভাগ সহ প্রতিষ্ঠানগুলিতে রাজনৈতিকভাবে  নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার উপর কেন্দ্র করে হওয়া উচিত। স্থায়ীভাবে সংস্কার নিশ্চিত করার জন্য সরকারের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের কার্যালয় এবং অন্যান্য জাতিসংঘের অধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা, পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিবেদন চাওয়া উচিত।

“গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে প্রায় ১,০০০-এরও বেশি বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছেন, যা বাংলাদেশে অধিকার-বিষয়ে শ্রদ্ধাশীল হয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার এক যুগান্তকারী সুযোগের সূচনা করেছে,” হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক এলেন পিয়ারসন বলেন। “ভবিষ্যতে সরকারগুলির যেকোনো দমন-পীড়ন সহ্য করতে পারে সেজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি দ্রুত এবং কাঠামোগত সংস্কার না করতে পারে তাহলে এই কষ্টার্জিত অগ্রগতি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে।”

বাংলাদেশে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০ বছরেরও বেশি গবেষণা ও ডকুমেন্টেশনের পাশাপাশি মানবাধিকার কর্মী, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য এবং বর্তমান ও প্রাক্তন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে এই সুপারিশগুলি তৈরি করা হয়েছে।

গত ১৫ বছর ধরে, হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার সমালোচক এবং বিরোধী দলের সদস্যদের জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নজরদারি এবং নির্যাতনের মাধ্যমে দমন করতে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করে রেখেছিল। হাসিনা ক্ষমতা সুসংহত করার সাথে সাথে, তার সরকার বিচার বিভাগ এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সহ তার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে রাখার এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপর তত্ত্বাবধান এবং জবাবদিহিতা বজায় রাখার জন্য ব্যবহৃত প্রতিষ্ঠানগুলিকেও দুর্বল করে দিয়ে ছিল। একজন পুলিশ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে, "প্রায়শই লাভজনক পদের জন্য যোগ্যতার চেয়ে” আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যার ফলে পুলিশ "ক্রমশ পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে ওঠে, বছরের পর বছর ধরে দলীয় ক্যাডারদের মতো আচরণ করে।"

মুহাম্মদ ইউনূস, ছাত্রকর্মীরা যাকে হাসিনার বিদায়ের কয়েকদিন পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য গুরুত্ব সহকারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা সহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলা বাতিল করেছে এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুম বন্ধের দাবি জানিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে, ইউনূসের নেতৃত্বে একটি কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন অফিস এবং সংবিধানে সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত ৬টি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সংস্কার বাস্তবায়ন শুরু করবে

অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ২০২৫ সালের মার্চ মাসে কাউন্সিলের অধিবেশনে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা যাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত মেয়াদের বাইরেও স্থায়ী সংস্কার নিশ্চিত করা যায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলে। দাতা সরকারগুলির উচিত বাংলাদেশে পুলিশ প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা খাতের সংস্কারে বিনিয়োগ করা, তবে এটি মূল কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া নয়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লক্ষ্য করেছে যে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের একটি বিরক্তিকর ধরণ আবারও দেখা দিয়েছে, যা এবার সাংবাদিক সহ প্রাক্তন আওয়ামী লীগ সমর্থকদের লক্ষ্য করে শুরু হয়েছে। পুলিশ আবারও নির্বিচারে মানুষকে আটক করছে এবং অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গণ ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করছে, যার ফলে পুলিশ কার্যত যে কাউকে গ্রেপ্তারের ভয় দেখাতে এবং হুমকি দিতে পারে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে প্রথম দুই মাসে, খুন, দুর্নীতি বা অন্যান্য অপরাধের অভিযোগে হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে ১,০০০ টিরও বেশি মামলা পুলিশ দায়ের করা হয়েছে। ৪০০ জনেরও বেশি আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং নেতা তদন্তের মুখোমুখি হচ্ছেন।

পূর্ববর্তী সরকারের আমলে নির্যাতনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। তবে, পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া গণ-অভিযোগ কেবল ন্যায়বিচারকে দুর্বল করে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় নিহত দুই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে আওয়ামী লীগের বিরোধী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা তাদের পুলিশ রিপোর্টে স্বাক্ষর করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন, যদিও তারা নিশ্চিত ছিলেন না যে তারা কার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে তাদের আত্মীয়ের হত্যার স্বীকৃতি দিতে চান, যার মধ্যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত অবিলম্বে অজ্ঞাত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং গণগ্রেপ্তার পরোয়ানা নিষিদ্ধ করা এবং সমালোচকদের লক্ষ্য করে অস্পষ্ট এবং অত্যধিক বিস্তৃত অভিযোগ আনার অনুমতি দেয় এমন আইন সংশোধন করা, বলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। আটককৃত যে কাউকে নিরাপদে এবং দ্রুত একজন বিচারকের সামনে হাজির করা নিশ্চিত করার জন্য আদালতের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সমস্ত আটককেন্দ্র জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত এবং স্বাধীনভাবে পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা উচিত।

হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংস আক্রমণের অভিযোগ বারবার আসছে কিন্তু পুলিশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাকস্বাধীনতাকে দমন করার জন্য ব্যবহৃত অপব্যবহারমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তে একটি সাম্প্রতিক অধ্যাদেশ হয়েছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা একই রকমের ক্ষতিকর বিধানকে অনুকরণ করে চলছে।

ইউনূস তার প্রশাসনকে বাকস্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার উপর জোর দিয়েছেন। তবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে কর্তৃপক্ষ পূর্ববর্তী সরকারের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে মনে করা সাংবাদিকদের উপর কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে আসছে। নভেম্বর পর্যন্ত, কর্তৃপক্ষ মনসুন  বিপ্লবের প্রতিবেদনের জন্য কমপক্ষে ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করেছে এবং সরকারী অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য প্রয়োজনীয় ১৫০ জনেরও বেশি প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করেছে। জাতীয় পতাকা অবমাননার জন্য পুলিশ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও দায়ের করেছে।

১৪ ডিসেম্বর জোরপূর্বক গুমের তদন্তকারী জাতীয় কমিশন তাদের প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে অনুমান করা হয় যে শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে ৩,৫০০ টিরও বেশি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে হাসিনা, শীর্ষ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক এবং মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা গুম তদারকিতে জড়িত ছিলেন। জোরপূর্বক গুমের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে আরও জানিয়েছেন যে শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের ঊর্ধ্বতন সদস্যরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আটকের বিষয়ে অবগত ছিলেন।

হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পরপরই, গোপন আটক কেন্দ্র থেকে তিনজনকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনটি ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ধরে তাদের আটক রাখার কথা অস্বীকার করে আসছিল। আইনজীবী মীর আহমেদ বিন কাসেম বর্ণনা করে বলেছেন যে তাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেখানে “বন্দীদের মৃত্যুর চেয়েও খারাপ অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য সতর্কতার সাথে তৈরি করা হয়েছিল।“ জাতীয় গুম তদন্তের জারি করা প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে নির্যাতন "কেবলমাত্র নিয়মতান্ত্রিক ছিল না বরং একে প্রাতিষ্ঠানিক রুপও দেয়া হয়েছিল।"

সরকারের উচিত জাতীয় তদন্ত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ভেঙে দেওয়া, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে তৈরি একটি সন্ত্রাস দমন ইউনিট, যা অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন এবং জোরপূর্বক গুমের জন্য দায়ী। প্রতিবেদনের ফলাফলের প্রতিক্রিয়ায়, র‍্যাব প্রধান একে এম শহীদুর রহমান ইউনিটের গোপন আটক কেন্দ্রগুলির কথা স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি ইউনিটটি ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে তবে র‍্যাব সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতিসংঘের বলপূর্বক গুম সংক্রান্ত কনভেনশনে সম্মতি দিয়েছে। নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে কনভেনশনের অপশনাল প্রোটোকলকে অনুমোদন দেয়া উচিত এবং জরুরি ভিত্তিতে প্রতিরোধ সংক্রান্ত উপকমিটিকে বাংলাদেশ সফর করে সুপারিশ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো উচিত।

বাংলাদেশের বিভেদ সৃষ্টিকারী রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যেও প্রবেশ করতে পারে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর স্বাধীন বেসামরিক লোকদের দিয়ে তত্ত্বাবধান প্রতিষ্ঠা করা, যাতে সকল আটক স্থানের অঘোষিত পরিদর্শন করার ক্ষমতা থাকে। বল প্রয়োগের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদন্ডও প্রয়োগ করা উচিত, স্পষ্ট করে বলা উচিত যে নিরাপত্তা বাহিনীর যে কোনও সদস্য যদি তা লঙ্ঘন করে তবে তাকে জবাবদিহি করতে হবে।

সদস্য দেশগুলির উচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে কাজ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার অফিস কর্তৃক বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্দেশ কার্যকর করা এবং কাউন্সিলে নিয়মিত প্রতিবেদন তৈরি করা।

“বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১৫ বছরের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারকে পরিবর্তন করে উল্টে ফেলার মত বিশাল কাজ রয়েছে, ” পিয়ারসন বলেন। “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত কাঠামোগত সংস্কারকে শক্তিশালী করার জন্য জাতিসংঘের সমর্থন গ্রহণ করা যাতে অতীতের অপব্যবহার বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নীলনকশায় পরিণত না হতে পারে।”

নির্বাচিত সাক্ষাৎকারসমূহ

১৫ জুলাই যখন সহিংসতা শুরু হয়, তখন নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিক্রিয়া জানায়, নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে তাজা গুলি চালায় এবং কিছু ক্ষেত্রে পালিয়ে যাওয়ার সময় লোকজনকে পিছন থেকে গুলি করা হয়। পরে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “আমি অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিতে গুলি চালাতে দেখেছি... অনেক ক্ষেত্রে, আমি অফিসারদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে না থাকা সত্ত্বেও তাজা গুলি চালাতে দেখেছি।”

১৮ বছর বয়সী আমির হুসেন বলেন, ১৯ জুলাই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালালে তিনি ভিড়ের মধ্যে আটকা পড়েন। তার জীবন বাঁচানোর চেষ্টার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন:

পুলিশ যখন আমার পিছনে দৌড়াচ্ছিল, তখন আমি একটি নির্মাণাধীন ভবনে উঠে পালানোর চেষ্টা করতে থাকি। যখন আমি চতুর্থ তলায় পৌঁছাই, পুলিশ আমাকে লাফ দিতে বলে, কিন্তু আমি লাফ দেইনি কারণ আমি জানতাম যদি আমি তা করি তাহলে আমি মারা যাব। আমি ভবনের চতুর্থ তলায় রডের সাথে ঝুলে থাকার চেষ্টা করি। আমি ঝুলে থাকা অবস্থায় তৃতীয় তলা থেকে একজন অফিসার আমার দিকে ছয় রাউন্ড গুলি চালায়, এবং সবগুলোই আমার পায়ে লাগে। তারপর তারা চলে যায়। পরে, যখন আমার প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছিল, তখন আমি তৃতীয় তলায় লাফ দেই যার ফলে আমার পা আরও ভেঙে যায়। আমি এখনও জানি না কেন তারা আমাকে তাড়া করে গুলি করেছিল।

২০ জুলাই, কলেজ ছাত্র এবং একজন পুলিশ অফিসারের ছেলে ইমান হোসেন তায়েম দুই বন্ধুর সাথে একটি চায়ের দোকানে ছিলেন, ঠিক তখনই নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালাতে শুরু করে। তাদের একজন যখন রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হয়, তারা দোকানের শাটার নামিয়ে ভেতরে লুকিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বন্ধুদের একজন মোহাম্মদ রাহাত হোসেন বলেন, ১০-১৫ জন পুলিশ দোকানে প্রবেশ করে।

পুলিশ যখন শাটার টেনে খুলে দিল, তখন আমরা একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম, আর ১০-১৫ জন অফিসার আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে। তারা তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে আমাদের উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। কিছু অফিসার বলছিল আমাদের গুলি করা উচিত, আবার কেউ কেউ পরামর্শ দিচ্ছিল আমাদের পায়ে গুলি করার। আমি আর তায়েম একসাথে দাঁড়িয়ে থাকার সময়, পুলিশ অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে আমাদের পালিয়ে যেতে বলে। তায়েম ইতিমধ্যেই দুই-তিন কদম এগিয়ে গিয়েছিল, ভেবেছিল আমি তাকে অনুসরণ করব, কিন্তু আমি নড়িনি। সে যখন দৌড়াচ্ছিল, তখন পেছন থেকে তাকে দুটি গুলি করা হয়, .... যখন সে পরে যাবার মত অবস্থায় চলে যাচ্ছিল, আমি তার কাছে ছুটে গেলাম,  আর তখন তাকে ধরে রাখলাম। আমি তাকে টেনে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পুলিশ গুলি চালাতে থাকে, আর আমার পায়ে একটা রাবার বুলেট লাগে।

 নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা পথচারীদের উপর আক্রমণ একটি বড় রকমের নমুনা বলে মনে হচ্ছে। একজন পুলিশ কর্মকর্তা পরে হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, “বাড়ি থেকে যারা ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষ করেছিল পুলিশ তাদের উপরেও গুলি চালিয়েছে, ভয় তৈরি করার এবং একটি বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে লোকেরা তাদের চারপাশে কী ঘটছে তা লক্ষ্য করা উচিত হবে না।” পুলিশ কর্মকর্তারা বর্ণনা করেছেন যে বিক্ষোভ জুড়ে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগের জন্য স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট উভয় নির্দেশনাই পেয়েছিল। একজন কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করেছেন,

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের কঠোর হতে এবং অরাজকতা ছড়ানো কোনও অপরাধীকে রেহাই না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা স্পষ্টভাবে "গুলি" করার শব্দটি ব্যবহার করেননি, তবে তাদের নির্দেশাবলী স্পষ্ট ছিল: সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করুন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যা প্রয়োজন মনে করেন তা করুন, কঠোর অবস্থান গ্রহণ করুন।

জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার

হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর কিছুক্ষণ পরেই, জোরপূর্বক গুমের শিকার হওয়া তিনজন - মাইকেল চাকমা, মীর আহমেদ বিন কাসেম (আরমান) এবং আবদুল্লাহিল আমান আজমি - মুক্তি পান। তিনটি মামলাতেই কর্তৃপক্ষ বছরের পর বছর ধরে তাদের আটক রাখার কথা অস্বীকার করে আসছিল। তারা সকলেই সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে তাদের নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল কিন্তু একই আটক কেন্দ্রে বন্দী অন্যদের কথা শুনতে পাওয়া যেত। 

২০১৬ সালের আগস্টে আজমি ও আরমানের সাথে হুম্মাম কাদের চৌধুরীকে আটক করা হয়। তারা তিনজনই বিরোধী নেতাদের ছেলে ছিলেন, যাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার ও দোষী সাব্যস্ত করেছিল। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে হুম্মাম চৌধুরীকে তার বেআইনি আটকের বিষয়ে চুপ থাকার শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়। হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি কেবল হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাথে দেখা করতে রাজি হন। "আমি জানি যে সেই ভবনে অন্যান্য সেল ছিল, এবং আমি জানি যে সেই সেলগুলি পূর্ণ ছিল। সেখানে আরও লোক ছিল," তিনি বলেন। আজমি ও আরমানের সাথে তার নিখোঁজের সময়কালের তুলনা করে তিনি বলেন, "সাত মাস, আমি ভেবেছিলাম পুরো একটি জীবনকাল। আট বছর। আমি বুঝতে পারছি না যে কেউ কীভাবে এভাবে বেঁচে থাকবে।"

৯ আগস্ট, ২০১৬ তারিখে আরমানকে তার স্ত্রী, বোন এবং সন্তানদের উপস্থিতিতে তার বাড়ি থেকে সাত-আটজন অফিসার তুলে নিয়ে যান। আইনজীবী হিসেবে তিনি তার গ্রেপ্তারের জন্য পরোয়ানা দাবি করেন, কিন্তু অফিসাররা তা প্রত্যাখ্যান করে তাকে বাড়ি থেকে টেনে বের করে নেয়,এরপর একটি ভ্যানে তুলে এবং চোখ বেঁধে ফেলে। যখন সে প্রতিবাদ করে, তিনি বলেন, একজন অফিসার উত্তর দেয়, "দয়া করে আমাদের আপনার সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করতে বাধ্য করবেন না।"

তাকে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে ২৪/৭ রাখা হত, শুধু ওয়াশরুম ব্যবহার করা বা খাবার খাওয়া ছাড়া। তিনি বলেছিলেন যে তিনি মাঝে মাঝে কাছের কক্ষে অন্যান্য বন্দীদের নির্যাতনের কথা শুনতে পেতেন। “আমি চিৎকার এবং জিজ্ঞাসাবাদের শব্দ শুনতে পেতাম। প্রাপ্তবয়স্করা ছোট বাচ্চাদের মতো চিৎকার করছিল। এটা সহ্য করা সত্যিই কঠিন, ” তিনি বলেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেছিলেন যে তিনি তাকে আটককারী অফিসারদের বলেছিলেন “হয় আমাকে মেরে ফেলুন অথবা ছেড়ে দিন। কিছু করুন। আমি আর এটা সহ্য করতে পারছি না।” তিনি বলেছিলেন যে তারা তাকে বলেছিলেন যে এটি তাদের হাতের বাইরে: “‘তারা কেবল আমাদের নাম, অবস্থান, লক্ষ্যবস্তুর উপর গোয়েন্দা তথ্য দেয় যাতে তাদের তুলে নেওয়া যায়, এখানে আনা যায় এবং তাদের রাখা যায়। আদেশ আসে; আমরা অনুসরণ করি। আমরা নির্বাচন করি না অথবা সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার আমাদের নেই। এটি সর্বোচ্চ স্থান থেকে আসে।’ তারা আমাকে এটাই বলেছিল,” তিনি বলেন।

আদিবাসী অধিকার কর্মী মাইকেল চাকমা ৯ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে নিখোঁজ হন। তিনি জানান, চার-পাঁচজন লোক তাকে একটি চায়ের দোকান থেকে তুলে নিয়ে যায়, যারা দাবি করে যে তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মী। তারা তাকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে, চোখ বেঁধে, আটক স্থানে নিয়ে যায় এবং একটি কক্ষে রেখে দেয়। তারা তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী কর্মীদের বিক্ষোভ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

আটকের সময়, বিশেষ করে প্রথম সপ্তাহগুলিতে, চাকমা বলেন যে তাকে নির্যাতন করা হয়েছিল। তিনি বলেন যে চোখ বেঁধে, অফিসাররা তাকে পিঠের পিছনে হাত রেখে একটি চেয়ারে বেঁধে রাখত, তাকে বিশ্বাস করাত যে তাকে বৈদ্যুতিক চেয়ারে বন্দী করা হচ্ছে এবং যদি সে তাদের তথ্য না দেয় তবে তাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে হত্যা করার হুমকি দিত। একজন অফিসার তাকে বলেছিলেন, "আমরা তোমাকে ৩০ বছর ধরে এখানে রাখতে পারি এবং কেউ তোমাকে কখনও খুঁজে পাবে না।"

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country