গতমাসে, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থার তিনজন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ সরকারকে যৌথভাবে চিঠি লিখে জানিয়েছেন যে পানিতে প্রাণঘাতী আর্সেনিক দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
আর্সেনিক সমস্যাটি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হবার দুই দশক পরেও, বাংলাদেশে আনুমানিক ২ কোটি মানুষ (যাদের বেশিরভাগই গ্রামের দরিদ্র মানুষ) এখনও অনিরাপদ দূষিত পানি পান করে।
আর্সেনিকযুক্ত পানি রঙহীন, স্বাদহীন এবং গন্ধহীন। তবে স্বল্প মাত্রায় আর্সেনিক গ্রহণের কারনে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে, যদিও অসুস্থতা (ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং ফুসফুসের রোগ) পুরোপুরিভাবে দেহে ছড়িয়ে যেতে কয়েক বছর লাগবে।
জাতিসংঘের স্বাস্থ্য অধিকার অধিদপ্তরের - দারিদ্র্য, নিরাপদ পানীয় জল এবং স্যানিটেশন অধিকার রক্ষার বিশেষ প্রতিবেদকগণ ২০১২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বুলেটিন প্রকাশ করেছেন। যেখানে তারা উল্লেখ করেছেন যে বাংলাদেশে আর্সেনিক সংক্রান্ত অসুখের কারনে প্রতি বছর প্রায় ৪৩ হাজার মানুষের মৃত্যুর ঘটবে।
বাংলাদেশে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম, পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা পরিমাপ করা হয়, একের পর এক সরকার , আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী, বেসরকারী সংস্থা অগভীর কূপগুলো পরীক্ষা করার প্রচেষ্টা চালায়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত, সারা দেশ জুড়ে ৫০ লক্ষ কূপ যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং ফলাফল তাদের মালিকদের কাছে জানানো হয়।
এ জাতীয় পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেছে যে আনুমানিক ২ কোটি মানুষের ব্যবহৃত কূপগুলোর পানিতে, আর্সেনিকের মাত্রা গ্রহণযোগ্য নিরাপদ পানির মাত্রার উপরে রয়েছে। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে যখনই একটি নিরাপদ কূপ ধারেকাছে রয়েছে, অনেক মানুষ দূষিত কূপ ব্যবহারের পরিবর্তে নিরাপদ কূপ ব্যবহার করেছে।
কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে এই ধরনের প্রচেষ্টার অবসান ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে, যে লাল রং দূষিত কূপ চিহ্নিতকরণে ব্যবহার করা হত তা ম্লান হয়ে গেছে।
২০১৫ সালে প্রকাশিত পানীয় জলের মান পরীক্ষা করার জন্য দেশব্যাপী যে গবেষণা করা হয়েছে তাতে পূর্ববর্তী পরীক্ষার অনুরূপ ফলাফল পাওয়া গেছে- ২ কোটি মানুষ জাতীয় মানদণ্ডের চেয়ে বেশী মাত্রায় আর্সেনিক গ্রহণ করছে। এ ফলাফলটি কোন ধরনের অগ্রগতি দেখায়নি। কোথায় ভুল হচ্ছে?
বাংলাদেশের আর্সেনিক সমস্যায় জর্জরিত এলাকায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আনুমানিক ১৫০ মিটার গভীর কূপ খনন করলে, সে পানিতে আর্সেনিক থাকে না। যা শতশত মানুষের নিরাপদ খাবার পানির যোগান দেবে।
সরকারের গভীরকূপগুলো জানসাধারনের জীবনরক্ষার জন্য একটি সম্ভনাময় পথ খুলে দেবে, কিন্তু গ্রামের বেশীর ভাগ পরিবারের জন্য তা স্থাপন করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
কিছু রাজনীতিবিদ এই জীবন-সংরক্ষণকারী জনগণের সম্পত্তি তাদের রাজনৈতিক সমর্থক এবং অনুসারী কাছে বিলিয়ে দিয়েছেন।
কাদের এ পানি পাওয়া উচিত, সে সম্পর্কে একটি দীর্ঘমেয়াদী আলোচনা শেষে, সরকারি নীতি বলে: " (নতুন কূপ) বরাদ্দকরণের জন্য ৫০ শতাংশ জায়গা এই এলাকার সংসদের সদস্যের সাথে প্রাসঙ্গিক আলোচনার পর চূড়ান্ত করা উচিত। "
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সরকারী কর্মকর্তা বলেছেন, “যদি ৫০ শতাংশ (নতুন বরাদ্দকৃত স্থান) পায় সংসদ সদস্য এবং ৫০ শতাংশ পায় উপজেলা চেয়ারম্যান (উপজেলা), তাহলে যাদের খুব প্রয়োজন তাদের জন্য স্থাপন করার কিছুই থাকবে না”।
গ্রামীণ সমাজে তার পরিণতি কি হবে? আমি একটি গ্রাম পরিদর্শন করেছিলাম যেখানে ৯০ শতাংশের বেশী কূপগুলো দূষিত কিন্তু সরকার নির্মিত কূপগুলো দেয়াল চত্বরের ভেতরে অথবা বাড়ির ভেতরে অবস্থিত যা শুধু একটি পরিবার ব্যবহার করতে পারে।
অন্য একজন সরকারী কর্মকর্তা বলেছেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) : “এসব (রাজনৈতিক প্রভাব) সমগ্র বাংলাদেশে চলছে”।
যেহেতু কিছু সংসদ সদস্য তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষার্থে দেশের ভোটারদের পুরস্কৃত করতে জনসাধারণের সম্পদ ব্যবহার করে, বাংলাদেশ এ কূপগুলো স্থাপন করছে যেখানে আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম এবং পানি সরবরাহ অপেক্ষাকৃত ভালো। সাধারণ অর্থে, নিরাপদ পানি সরবরাহকারী কূপগুলি সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে না যেখানে তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
সরকারী প্রকৌশলীরা এ বিষয়ে অবগত। প্রকৃতপক্ষে, কিছু প্রতিবেদন সর্বাধিক প্রয়োজনের এলাকাগুলোতে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানিয়েছে - কিন্তু সরকার সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
সরকারের বিশেষ দূতগণ লিখেছেন: “পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব এবং আর্সেনিক নিয়ন্ত্রণে অপর্যাপ্ততা, লক্ষ লক্ষ জনগোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।” সমস্যাটি স্বীকার করে, বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের তিনজন বিশেষ দূতদের যৌথ চিঠির কোন উত্তর দেয়নি।
সম্ভবত এ বিষয়টি অস্বীকার করা সরকারের কাছে থেকে প্রত্যাশিত। গত বছর আমাদের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা গেছে যে ২ কোটি মানুষ এখনও আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে, সরকারের স্থানীয় মন্ত্রী বাংলাদেশ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন যে, বাংলাদেশে বর্তমানে কেউ আর্সেনিক দূষণের শিকার নয়।
পানিতে আর্সেনিক দূষণ কার্যকরীভাবে মোকাবেলা করার জন্য সমস্যাটির ভয়াবহতা স্বীকার করা প্রয়োজন, এবং প্রথমবার আর্সেনিক দূষণ আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করার পর, সরকার ও আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী যে প্রতিশ্রুতি করেছিল, সেই একইভাবে কাজ করা।
কারিগরিক সমস্যা মোকাবেলা করা ছাড়াও বাস্তবিকভাবে খারাপ নেতৃত্বের মোকাবেলা করতে হবে।
খাবার পানিতে আর্সেনিক দূষণ প্রতিরোধ করার জন্য সরকারকে একটি জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং নতুন কূপ সে এলাকায় স্থাপন করতে হবে যেখানে আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশী। নতুন এলাকা বরাদ্দকরণে রাজনীতিবিদদের ক্ষতিকারক প্রভাবের অবসান হওয়া উচিত।