Skip to main content

বাংলাদেশঃ পোশাক কারখানার পরিদর্শন রিপোর্ট প্রকাশ কর

শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা মূল্যায়নের পূর্ণ ও সময়মত তথ্য প্রয়োজন

(ব্যাংকক) হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজকে বলেছে, ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজার বিপর্যয়কারী ঘটনায় কয়েক হাজার কর্মী নিহত ও আহত হওয়ার পর পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনের প্রতিবেদন প্রকাশে বাংলাদেশ সরকার ও বিক্রেতারা বিরাট ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলা ও ইংরেজিতে শ্রমিকদের বোধ্যগম্য ভাষায় রিপোর্টটি প্রকাশ কার দরকার।

রানা প্লাজার ভবনটির দেয়ালে বিরাট ফাটল হওয়ায় ভবনটি খালি করবার পর দিন পোশাক কারখানার মালিকরা রাজি করিয়ে এবং কিছু ক্ষেত্রে জোর করে কর্মীদের ফিরিয়ে আনে, যার ফলে ১১০০ এর অধিক শ্রমিক মারা যায়। এই শোকাবহ ঘটনার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার এবং পশ্চিমা বিক্রেতারা ৩৫০০ এর বেশি পোশাক কারখানার ভবনের কাঠামোগত মান এবং অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা পরিদর্শন করছে। পরিদর্শক দলগুলো যদিও পরিদর্শনের বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল, কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পার হয়েও বেসরকারি দলগুলো ৪০ এরও কম কারখানার রিপোর্ট প্রকাশ করে। সরকার তাদের করা কোন পরিদর্শনেরই তথ্য প্রকাশ করে নি।

“বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে নিরাপদ করার এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার প্রচেষ্টা কখনই সফল হবে না যতদিন পর্যন্ত সকল পোশাক কারখানার পরিদর্শনের বিস্তারিত প্রকাশ করা না হয়,” বলেন এশিয়া ডেপুটি পরিচালক ফিল রবার্টসন। “শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করা নিরাপদ কিনা সে সিদ্ধান্ত যেন জানতে পারে তারজন্য তাদের এই তথ্যের আবশ্যক।”

রানা প্লাজা ধসের ফলে শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার এবং বিদেশি বিক্রেতারা বিভিন্ন চুক্তি করে। বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১৫০০ পোশাক কারখানার পর্যবেক্ষণের জন্য দায়বদ্ধ যার মধ্যে অনেক কারখানা ঠিকাদারি কাজ করে। কিছু কিছু কারখানা একই ভবনে অবস্থিত এবং কিছু কারখানা বিশেষজ্ঞদের মতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইজেশন (আইএলও) অনুমোদিত এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় একটি কর্মসূচির অধীনে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর কর্মীরা ইতিমধ্যে ২৫০ এরও বেশি কারখানা পরিদর্শন করেছে।

সরকার ও আইএলও এই সমস্ত পর্যবেক্ষণের তথ্য প্রকাশের জন্য একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে, কিন্তু আজ অবধি সেখানে কোন তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এর একজন মুখপাত্র বলেন যে বুয়েটের তদন্তের কোন রিপোর্ট প্রকাশ নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।

এলায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি, যা উত্তর আমেরিকার ২৬টি বিক্রেতার একটি গ্রুপ, প্রায় ৬৮০টি পোশাক কারখানার পরিদর্শনের কাজ চালাচ্ছে। এটি সম্প্রতি ২৮টি কারখানার অগ্নিকাণ্ড, কাঠামোগত ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করেছে। এই সব কারখানায় সংশোধনমূলক কাজের প্রয়োজন আছে। রিপোর্টগুলোতে কিছু ছবি অন্তর্ভুক্ত আছে এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। এলায়েন্সের ওয়েবসাইট অনুযায়ী রিপোর্টগুলোর তথ্য শ্রমিক ও তাদের প্রতিনিধিদের জানানো হয়েছে, কিন্তু রিপোর্টির বাংলা সংস্করণ ইন্টারনেটসহ কথাওই এখনো প্রকাশ করা হয়নি। এলায়েন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ১৬ মে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন যে প্রতি মাসে আরো ১০ থেকে ১৫টি রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে।

১৭৫টি বিক্রেতা যাদের মধ্যে মূলত ইউরোপিয়ান বিক্রেতা আছে দ্বিতীয় আরেকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে যা বর্তমানে ১৫৪৫টি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করছে। তারা আইনত বাধ্যবাধকতাপূর্ণ একর্ড অন ফায়ার এন্ড বিল্ডিং সেফটির স্বাক্ষরকারী। তারা ১০টি কারখানার পরিদর্শনের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের রিপোর্টগুলি শ্রমিকদের বোঝার জন্য বাংলা, ইংরেজি উভয় ভাষায় ছবিসহ লেখা হয়েছে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে যে ১০টি কারখানার সবগুলোয় নিরাপত্তার সমস্যা আছে যা এখনও ঠিক করা হয়নি। একর্ডের ইঞ্জিনিয়ারদের পর্যবেক্ষণের পর কাঠামোগত সমস্যার জন্য বেশ কিছু কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে একর্ডের মুখপাত্র ইন্টারনেটে শীঘ্রই আরও রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল কভেনান্ট অন ইকোনমিক, সোশ্যাল এন্ড কালচারাল রাইটস’র পক্ষ হিসাবে আর্টিকেল ৭ এর অধীনে “কাজের যথাযথ এবং অনুকূল পরিবেশ” নিশ্চিতের মাধ্যমে “নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মত কাজের অবস্থান” নিশ্চিত করতে বাধ্য।

২০১৩ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ, ইইউ এবং আইএলও শ্রম অধিকার ও কলকারখানার নিরাপত্তা বিষয়ক এক চুক্তি করে। পরবর্তীতে যুক্ত হওয়া ইউএস সরকারসহ এই তিন চুক্তি স্বাক্ষরকারী “সকল আরএমজি ও নীটওয়্যার কারখানার তালিকার জনমূল্যায়নের উপযোগী একটি ডাটাবেইস প্রকাশ করা, যাতে কলকারখানার অবস্থান, মালিকানা, ইউনিয়ন বিরোধী কার্যকলাপ, বৈষম্য এবং অন্যায্য শ্রম অনুশীলনের অভিযোগের উপর সংগঠিত পরিদর্শনের ফলাফল, জরিমানা ও নিষেধাজ্ঞাসহ জাতীয় আইন অনুযায়ী গৃহীত প্রতিকারমূলক পদক্ষেপসমূহ অন্তর্ভুক্ত করা হবে এবং যা শ্রম, অগ্নি এবং ভবনের নিরাপত্তা পরিদর্শনের রিপোর্ট প্রকাশ করার একটি মাধ্যম” তৈরি করতে একমত প্রকাশ করে।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের সরকার বা বিদেশি বিক্রেতাদের পরিচালিত কলকারখানার পরিদর্শন সবসময় গোপন রাখা হয়েছে। হয় শ্রম আইন না হয় বিক্রেতাদের কোড অফ কন্ডাক্টের উপর ভিত্তি করে সংগঠিত এইরূপ পরিদর্শন শ্রম অধিকারের লঙ্ঘনসহ শ্রমিক ইউনিয়নের সদ্যসদ্যের হয়রানি ও বহিষ্কার অথবা কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, কারখানায় আগুন লাগা এবং ভবন ধসের ঘটনা প্রতিরোধ করতে খুব কম ভূমিকা পালন করেছে।

বেশ কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন যে, কারখানার পরিচালকরা প্রায়ই আগাম বিক্রেতাদের মনিটর বা নিরীক্ষকদের মাধ্যমে পরিদর্শনের কথা জেনে যেত এবং তাদের প্রতারিত করত যেন শিশু শ্রমিকদের লুকিয়ে রাখা যায় অথবা বাসায় পাঠিয়ে দেয়া যায় অথবা অনুপস্থিত নিরাপত্তার সরঞ্জাম অন্য কারখানা থেকে ধার করে আনা যায়। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে এক কারখানার মালিক বলেন যে, রানা প্লাজার ঘটনার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেয়ে বরং শুধুমাত্র “কাগজে ভাল দেখানোর জন্য” মূলত কারখানাগুলোতে নিরপত্তা পরিদর্শন করা হতো। উদাহরণ সরূপ, তিনি বলেন যে পরিদর্শকরা হয়তো অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের সংখ্যা গুণতো কিন্তু সেই যন্ত্র ব্যাবহার করবার জন্য কতজন শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তা জিজ্ঞাস করতে ব্যর্থ হত। তিনি আরও বলেন যে পশ্চিমা ব্রান্ডগুলো নির্ধারিত পরিদর্শকরা ঘনঘন নিরাপত্তার অবস্থার উন্নতির জন্য কারখানার মালিকদের কাছে অনুরোধ করত, কিন্তু সেই প্রতিকারমূলক কাজগুলো করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হত।

“রানা প্লাজার শ্রমিকদের ত্যাগের যথাযথ সম্মান তখনি হবে যখন শ্রমিকরা তাদের অধিকার সম্বন্ধে অবগত থাকবে এবং নিরাপত্তাহীন ভবনে কাজ করতে অস্বীকার করতে পারবে,” রবার্টসন বলেন। “বাংলাদেশের পোশাক শিল্প যদি আরও মুক্ত এবং স্বচ্ছ হয় তাহলে শ্রমিকরা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সুবিধা পাবে।”

প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং কোম্পানিগুলো যারা বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোকে নিরাপদ করার প্রক্রিয়ায় যুক্ত আছে তাদের জন্য ট্রেড ইউনিয়নসমূহের প্রচেষ্টাগুলোকে সমর্থন করাও জরুরি। আগের তিন বছরে মাত্র তিনটি ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনের সাথে রানা প্লাজার শোকাবহ ঘটনার পর ১৪০টি পোশাক কারখানার ইউনিয়নের নিবন্ধনের ঘটনা তুলনা করলে বোঝা যায় যে সরকার বেশি করে ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন করা শুরু করেছে। তারপরও বেশিরভাগ সংখ্যক কারখানার এখনও কোন ইউনিয়ন নেই।

শ্রম ইউনিয়ন গঠন না করার জন্য শ্রমিকদের উপর বিশাল চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একর্ড ও এলায়েন্স দ্বারা পরিদর্শিত পোশাক কারখানাগুলোসহ ২১টি কারখানার ৪৭ জন শ্রমিকের সাক্ষাতকার নিয়েছে। সেই সাক্ষাৎকারে শ্রমিকরা কারখানার পরিচালকদের ইউনিয়নের সাথে সংযুক্ত শ্রমিকদের হত্যার হুমকি দেয়াসহ ভয় দেখানো এবং দুর্ব্যবহার করার ঘটনার অভিযোগ করেছে।

ইউনিয়নের কিছু প্রবর্তক তাদের উপর মারধরের অভিযোগ করেন, এবং অন্যান্যরা তাদের চাকরি হারানোর বা জোরপূর্বক পদত্যাগের কথা বলেন। স্থানীয় দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে আবাসস্থলসহ কর্মস্থলের বাইরে শ্রমিকদেরকে ভয় দেখানো এবং আক্রমণ করবার ঘটনায় কারখানার মালিকদের জড়িত থাকবার কথাও তারা বলেন। নারী শ্রমিকরা যৌন হয়রানি বা যৌনতা সম্পর্কিত অপমানের অভিযোগও করেন। “শ্রমিকদের সাথে যেন আর দুর্ব্যবহার করা না হয় এবং তাদের যেন নিরাপত্তাহীন কারখানায় জোরপূর্বক কাজ করানো না হয় তা নিশ্চিত করার চাবিকাঠি হচ্ছে স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন”, রবার্টসন বলেন। “বাংলাদেশ সরকারের উচিত অবিলম্বে এই সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন বিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।”

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country