Skip to main content

বাংলাদেশঃ কারখানার মৃত্যু এড়ানো যেত

বিশ্ব ব্র্যান্ডগুলোর শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

(নিউ ইয়র্ক) - হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ মন্তব্য করেছে অক্টোবরে বাংলাদেশের এক কাপড় মিলে (২) ঘটা অগ্নিকাণ্ডে সাতটি মৃত্যু এড়ানো যেত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে দেয়ার সাক্ষাৎকারে আসওয়াদ কম্পোসিট মিলসের শ্রমিকরা জানায়, কারখানার জল-কামানটি ঠিকমতো কাজ না করায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

শুধু গত বছরে তৈরিপোশাক কারখানায় হাজারের বেশি শ্রমিকের নিহত হওয়ার একের পর এক এসব দুর্ঘটনার সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ড ছিল সর্বশেষ এটি। এসব ঘটনা বিদেশী বিক্রেতাদের তৈরিপোশাক সরবরাহে জড়িত কারখানায় নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে তাদের দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।

৮ অক্টোবরের অগ্নিকাণ্ডে আসওয়াদ কম্পোসিট মিলস-এ সাতজন নিহত হয়।

আসওয়াদ বাংলাদেশের অন্যান্য কারখানাতে বস্ত্র সরবরাহ করত যারা ওয়াল্মার্ট, গ্যাপ, এইচএন্ডএম ও ক্যারেফুউর মতো উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপিয় খদ্দেরদের পোশাক তৈরি করে। বাংলাদেশ সরকার ও প্রাইমার্ক নামের এক বিক্রেতা জানিয়েছে যে অগ্নিকাণ্ডের আগেই তারা নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ করে কিন্তু তারপরও এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অন্যান্য কোম্পানি বলেছে আসওয়াদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক না থাকায় তারা পরিদর্শনের ব্যবস্থা করেনি।

এশিয়ার পরিচালক ব্র্যাড এডামস (৩) বলেন, “বাংলাদেশের শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জন্য সস্তায় কাপড় তৈরি করতে গিয়ে মারা যাচ্ছে।

“দেরিতে হলেও বিক্রেতারা বলছে যে তাদের জন্য পোশাক তৈরি করা কারখানায় নিরাপত্তার মান বৃদ্ধি করতে তারা সাহায্য করবে। তবে পুরো সাপ্লাই চেইনে নিরাপত্তা মান লঙ্ঘন রোধ না করতে পারলে প্রক্রিয়াটি ত্রুটিপূর্ণ রয়ে যাবে।”

২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসে ১,১০০-র বেশি মানুষের প্রাণ হারানোর ঘটনায় সজাগ হয়ে বাংলাদেশে কাজ করা বেশিরভাগ বিদেশী বিক্রেতা তাদের জন্য সরাসরি কাপড় তৈরি করা শত শত কারখানার আগুন ও ভবন সম্পর্কিত নিরাপত্তা বিধানে উন্নতি আনার অঙ্গীকার করে। কিন্তু তাদের এ অঙ্গীকার সাব-কনট্রাক্টর ও আসওয়াদের মত সাপ্লাইকারীদের বেলায় প্রযোজ্য নয়, যদিও তারা সাপ্লাই চেইনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা থাকে।

অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে সরকারি তদন্তের প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ হয়নি। কিন্তু দুই শ্রমিক জানিয়েছে যে ড্রাইং মেশিনের চিমনি অতিরিক্ত গরম হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে অনেক শ্রমিক এবং কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বলেন, শত শত শ্রমিককে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়। আগুন নিভাতে গিয়ে ওই সাতজন মারা যায়। তারা জানায়, দমকল বাহিনীর আসতে আড়াই ঘণ্টা লেগেছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কারখানার ৮ জনের সাক্ষাৎকার নেয়। তাদের ৩ জন যেই ঘরে আগুন লেগেছিল সেখানে আগুন লাগার সময় তারা উপস্থিত ছিল। কেউ কেউ ঘটনার বিবরণ দিতে রাজি হয়নি। তাদের আশঙ্কা এই বিষয়ে কথা বললে তাদের চাকরি যেতে পারে।

শ্রমিকরা আগুন নেভাতে চেষ্টা করে

আগুন নেভাতে চেষ্টা করা এক শ্রমিক জানায় যেতিনি যেই হোস-পাইপ দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে তাতে বলতে গেলে পানিই ছিল না। অগ্নি প্রশিক্ষণ পায়নি এক লোক বলেন, “আমার মনে হয় পানি খুব কম থাকায় তারা মারা যায়।

“একেবারে কোন পানি ছিল না বললেও ভুল হবে না কারণ আমরা যখন হোস-পাইপটি দ্বিতীয়বার চালু করি তখন ফোঁটা ফোঁটা পানি বের হচ্ছিল।”

আরেকজন শ্রমিক জানায় যেতিনি চিমনি থেকে কারখানার ফ্লোরে আগুন ছড়িয়ে যেতে দেখেছে। সেই সময় ফ্লোরে “সুতা, কাপড়, মেশিন, ডাইং কেমিকেল ও বস্ত্র” ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।

“আমি ‘আগুন, আগুন’ বলে চিৎকার করতে থাকি। তখন আমার চারপাশের শ্রমিকরা দল বেঁধে হোস-পাইপ দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে।” - এক শ্রমিক জানায়। “আমরা কিছু পানি আগুনে ঢালি। কিন্তু পর্যাপ্ত পানি না থাকায় আমরা আগুন নেভাতে পারছিলাম না। তাই আগুন বাড়তে থাকে এবং আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে থাকে।”

তৃতীয় শ্রমিক বলেন, “আমার সহকর্মীদের আগুন নিয়ে চিৎকার শুনলে আমি সেদিকে যাই। তাদেরকে আগুনে পানি ঢালতে দেখি। কিন্তু আগুন বাড়তে থাকে আর সেখানে পানি ছিল না। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আর কিছু না ভেবে পালিয়ে যাই।” অগ্নিকান্ডের পর দিন একটি সভায় সিনিয়র ম্যানেজার শ্রমিকদের বলেন যে বাইরের কাউকে পানি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা যাতে কেউ না বলে। সেই সভায় উপস্থিত পাঁচ শ্রমিকের সাথে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ কথা হয়। তাদের মধ্য থেকে একজন বলেন, “সে আমাদেরকে জানায় যে তোমাদের বোনাস ও বেতন সময় মত দেয়া হবে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কাউকে বল না। বললে আমরা আর কারখানা চালাতে পারবো না।”

আসওয়াদ মিলস এর মালিক পালমাল গ্রুপের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর নাফিজ সিকদার বলেন, এমন কোন মিটিং কখনোই হয়নি। তিনি আরো বলেন যে জেনারেটর চালু করার সময় এক দুই মিনিটের জন্য পানির সাপ্লাই হয় তো বন্ধ ছিল। তাছাড়া হাইড্র্যান্ট সিস্টেমটি মোটামুটি ভালো ভাবেই চলতো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে সাক্ষাৎকার দেয়া আরেকজন শ্রমিক একই কথা বলে।

“আগুন নেভানোর জন্য প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে আমাদের হাইড্র্যান্ট সিস্টেমটি বারো ঘণ্টা ব্যবহার করা হয়েছিল। এই বিষয়ে শেষ প্রতিবেদন দমকল বিভাগ থেকেই আসবে, তবে পানির চাপ ঠিকই ছিল। আইন অনুযায়ী হাইড্র্যান্ট সিস্টেম বসানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু তারপরেও আমাদের কারখানায় সেটার ব্যবস্থা করেছিলাম”- সিকদার হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানান। তিনি জানান যে কারখানাটি প্রত্যেক বছর কারখানা ও আগুন সম্পর্কিত লাইসেন্স পেয়ে ধাকে, তবে এ কথাও ঠিক যে সাম্প্রতিকেএক তদন্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গলদ ধরা পড়ায় সরকার কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে।

দ্য নিউ এইজ পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী অগ্নিকান্ডটি এই তদন্তের পরপরই ঘটে। রিপোর্টে শ্রমসচিব মিকাইল শিপারের বরাত দিয়ে বলা হয়, “কারখানাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ এগসস্ট ফ্যান ছিল না। মেশিন রুমেও পর্যাপ্ত কুলিং সিস্টেম ছিল না। তাছাড়া কারখানার ওয়াকওয়েটি সরু ছিল।” সিকদারে মতে এসব অভিযোগ “বানোয়াট”।

কোম্পানির দলিলে উল্লেখিত বিদেশী বিক্রেতাদের নাম

আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানা থেকে প্রাপ্ত ও পরবর্তীতে কপি করা দলিল থেকে জানা যায় যে গত বারো মাসে ওয়াল্মার্ট, গ্যাপ, আমেরিকান ঈগল, এইচএন্ডএম, প্রাইমার্ক, আসডা, নেক্সট, ক্যারেফুউর, লাকস্টা, জাস্ট জিন্স, টার্গেট (অস্ট্রেলিয়া) এবং উলসওয়ার্থ (অস্ট্রেলিয়া) আসওয়াদের ক্রেতা ছিল। এদের মধ্যে অন্তত একটি কোম্পানি, প্রাইমার্ক, অগ্নিকাণ্ডের আগে কারখানা পরিদর্শন করে। সেই পরিদর্শনে আচরণ-বিধির লঙ্ঘন ধরা পড়ে। অন্যান্য কোম্পানি বলেছে যে তারা কারখানায় যায়নি কারণ সেই কারখানার সাথে তাদের সরাসরি সম্পর্ক ছিল না।

ওয়ালমার্টের মালিকানাধীন যুক্তরাজ্যের আসডা জানিয়েছে যে সে তার কর্মপন্থা বদলানোর কথা ভাবছে। ৯ অক্টোবর এই বিক্রেতা বিবৃতিতে বলে, “বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা ভেবে, ওয়াল্মার্টের সহ আমাদের মনে হয়েছে যে বাংলাদেশ সরকার ও তৈরিপোশাক শিল্পমালিকদের উৎপাদনের পরবর্তী পর্যায়ে কারখানার নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করা দরকার।” একই দিনে যুক্তরাজ্যের বিক্রেতা নেক্সট এক বিবৃতিতে জানায় যে “অগ্নিকান্ডের কারণটি জানা, নিয়ম অনুযায়ী নেক্সট তার কর্মপ্রক্রিয়া পর্যালোচনা করবে। পর্যালোচনা করে তারা দেখবে- বাংলাদেশের মত চরম ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় সাপ্লাই-চেইনের আরো নিচ পর্যন্ত তদারকির দরকার আছে কিনা।” গ্যাপও জানিয়েছে যে এই দুর্ঘটনার কারণেই বোঝা যাচ্ছে কেন “বাংলাদেশে ভবন ও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নতির জন্য আরো অনেক কাজ করতে হবে।”

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গ্যাপ ও ওয়াল্মার্ট সহ উত্তর আমেরিকার ২৩টি কোম্পানি আলায়ান্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি গঠন করে। (৪)  ১০১টির বেশি ফার্ম, যাদের বেশিরভাগ ইউরোপভিত্তিক, বাংলাদেশের অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা সংক্রন্ত পৃখক দলিলে সই করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে যে আইনগত বাধ্যবাধকতা সম্পন্ন এই চুক্তির ফলে নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনা প্রকাশ হলে তারা তার জন্য কিছু করতে বাধ্য থাকবে যা এলায়েন্সেটির মতো নয়।

১০ অক্টোবর এক বিবৃতিতে এ দলিলে স্বাক্ষরকারী ফার্মগুলো জানায় যে আসওয়াদ কম্পোসিট মিলস তাদের চুক্তির আওতায় না পড়লেও তারা “দলিলের মূল নীতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এবং বাস্তব প্রয়োজনের কথা ভেবে অগ্নিক্যান্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের ও তাদের পরিবারকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করবে যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা আর না ঘটে।” আসওয়াদের অর্ডার বইয়ে উল্লেখিত কোম্পানির নামগুলোর মধ্যে জাস্ট জিন্স অফ অস্ট্রেলিয়া উল্লেখিত দলিলে সই করেনি বা অ্যালায়ান্সে যোগ দেয়নি। অগ্নিকান্ডের পর উলসওয়ার্থ চুক্তিতে সই করে।

“শেষ পর্যন্ত বিক্রেতারা নীতিগতভাবে বাংলাদেশের সাপ্লাই চেইনের উপর-নিচ সবখানে তাদের দায়বদ্ধতা আছে মেনে নিতে শুরু করেছে। ব্যাপারটি উৎসাহদায়ক।” - এডামস বলেন।

“তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এটার বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা দেখা যাতে তাদের পোশাক তৈরির কারখানাগুলোয় কাজের নিরাপদ স্থান হয়ে ওঠে।”

 

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country