(ব্যাংকক) — হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ বলেছে, বাংলাদেশ সরকারের নতুন কোভিড -১৯ বিধিনিষেধ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ত্রাণ সহায়তা পাবার পথ কে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলেছে। লকডাউন ব্যবস্থা শরণার্থী শিবির থেকে মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মীদের সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমিয়েছে এবং শরণার্থীদের মারাত্মক খাদ্য ও পানির ঘাটতি ও রোগ প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের নিশ্চিত করা উচিত, যে কোনও মহামারী সংক্রামক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় মানবিক সহায়তা কর্মীদের খাদ্য, পানি, এবং স্বাস্থ্যসেবার সরবরাহ করতে বাধা না দেয়া, অথবা সবথেকে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকা সহিংসতা ও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারী ও মেয়েসহ শরণার্থীদের রক্ষার কাজে বাধা না দেয়া।
“কোভিড -১৯ এর বিস্তার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রক্ষা করা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন, তবে লকডাউন ব্যবস্থা থেকে আসা ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহন করাও উচিত,” বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া ডিরেক্টর ব্রাড এডামস। “কোভিড -১৯ সম্পর্কিত যে কোনও বিধিনিষেধগুলি মানবিক সহায়তা প্রদানকারী গোষ্ঠীগুলির খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবা এবং সুরক্ষা সরবরাহের ক্ষমতাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধা দেওয়া উচিত নয়।"
৮ ই এপ্রিল, ২০২০, বাংলাদেশ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার একটি নির্দেশনা জারি করেছিলেন যা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ‘অতীব জরুরি’ পরিষেবা ও সুযোগ সুবিধাগুলোর পথে বাঁধা তৈরি করে এবং মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মীদের প্রবেশাধিকারকে ৮০ শতাংশ কমিয়েছে। শিবিরগুলিতে কোভিড -১৯ এর প্রাদুর্ভাব এড়াতে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাথে সাক্ষাৎকারে ১৪ জন মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মীরা বলেছিলেন যে যদিও এই সেবাগুলি ‘অতীব জরুরি’ বলে মনে করা হয়, তবে এই ব্যাপকভাবে কার্যক্রম হ্রাসের কারনে তাদের কর্মকাণ্ডের সক্ষমভাবে পরিচালনায় প্রভাব পড়ছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা বলেন এই ধরনের প্রতিবন্ধকতা এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য পরিণতি ঘটাতে পারে।
প্রতিবেশী মিয়ানমারের নৃশংসতা থেকে পালিয়ে এসে ৯০০,০০০ এরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের দক্ষিণের শরণার্থী শিবিরগুলিতে বসবাস করছে। চরম বিধিনিষেধপূর্ণ পরিস্থিতি শিবিরগুলিকে কোভিড -১৯ ভাইরাসের দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে যদি সেখানে কোনও প্রাদুর্ভাব ঘটে।
সরকারের নতুন নির্দেশনায় ‘অতীব জরুরি’ সেবাগুলোকে সুরক্ষা দেয় যার মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পানি, খাদ্য, গ্যাস, স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থা, নতুন আগতদের সনাক্তকরণ এবং "কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা।" কিন্তু মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মীরা জানিয়েছেন কর্মীদের ওপর বিধিনিষেধ এবং ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতা (Internet blackout) তাদের কর্মকান্ডকে বাধাগ্রস্ত করছে যা গুরুত্বপূর্ণ সেবার অন্তর্ভুক্ত এবং যা কোভিড-১৯ এর হুমকিকে কার্যকরীভাবে মোকাবেলা করবে।
কর্মী হ্রাসের ফলে হামের মত কয়েকটি টিকা (ভ্যাকসিন) কর্মসূচি বন্ধ হয়ে গেছে। শিবিরগুলিতে অতীতে হামসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল। একজন স্বাস্থ্যকর্মী বলেছেন:
বিধিনিষেধ এবং লোকবল সঙ্কটের কারনে, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বা ক্লিনিকে টিকা (vaccination) সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমি বলে বোঝাতে পারব না ভ্যাকসিনের কার্যক্রম বজায় রাখা কতটা জরুরি। কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব নিয়ে কাজ করার অর্থ এটা হওয়া উচিত নয় যে আমাদের অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের কাজ করা বন্ধ করে দিব। অন্যথায় শরণার্থী শিবিরগুলি কলেরা বা হামের মতো আনুষঙ্গিক আরো প্রাদুর্ভাবের শিকার হতে পারে।
কয়েকটি শিবির মারাত্মক খাদ্য এবং পানির স্বল্পতার সম্মুখীন হচ্ছে। চারটি শিবির- ৭,৯, ১১ এবং ১৮ নং শিবির থেকে ১৭ জন শরণার্থী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে যে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্য সহায়তা পুনরায় সরবরাহ করা হচ্ছেনা এবং পরিমাণেও হ্রাস পাচ্ছে এবং কিছু স্থানে কোন খাবারের পানি নেই। মানবিক সহায়তা কর্মীরা বলেছেন বিধিনিষেধগুলো খাদ্য ও স্যানিটেশনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে, যেগুলোকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের সময় মানব স্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয়। একজন মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মকর্তা কিছু এলাকায় উপচে পড়া টয়লেটগুলির বিষয়ে অভিযোগ পাওয়ার ব্যাপারে অবহিত করেছেন কারণ এই সমস্যাগুলি সমাধান করার জন্য পর্যাপ্ত কর্মী সদস্য নেই।
পানির অভাব এবং স্যানিটেশনের অপর্যাপ্ততা বৃদ্ধ বয়সীদের এবং শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ঝুঁকি বাড়ায় যারা কার্যকরী টয়লেটে এবং ধৌতকরণ সুবিধার স্থানে সহজেই পৌঁছাতে বা লাইনে অপেক্ষা করতে পারে না। নিরাপদ এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যকর জায়গা ছাড়া, মহিলা এবং মেয়েরা টয়লেট ব্যবহার এবং আক্রমণ বা হয়রানির মধ্যকার ঝুঁকি বেঁছে নিতে বাধ্য হতে পারে।
শিবিরগুলিতে নারী ও মেয়েদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সাম্প্রতিক লকডাউন ব্যবস্থাসমূহের কারণে "শিশু এবং মহিলা-বান্ধব জায়গাগুলি” তে কাজ করা এবং লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা ঘটনা পরিচালনা সহ সকল সুরক্ষা কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেছে। নারী অধিকারকর্মীরা বলেছেন যে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের কাছে পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান রিপোর্ট রয়েছে। তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে, মানবিক সহায়তা প্রদানকারী কর্মীরা সমর্থন এবং সুরক্ষা পরিষেবাদি দূর থেকে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সুরক্ষা দলের (protection team) এক সদস্য বলেছেন যে শিবিরে কর্মরত অফিসারদের ব্যতীত, "এখন যদি কোনও মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়, তবে সে খবর আমার কাছে পৌঁছাবে না এবং তিনি আমাদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাবেন না।"
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা, ইউএনএইচসিআর, "লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা থেকে বেঁচে থাকাদের জন্য অতীব জরুরি সেবাগুলি অত্যাবশ্যক হিসাবে চিহ্নিত করা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের জন্য সহজগম্য" নিশ্চিত করার জন্য সরকারগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে।
শিবিরগুলিতে প্রবেশের অনুমতিপ্রাপ্ত কিছু সহায়তা কর্মীদের কোভিড -১৯ থেকে রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের অভাবে তাদের অতীব জরুরি সেবাপ্রদান স্থগিত করতে হয়েছে। রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকসহ যারা অতীব জরুরি সেবা দিচ্ছে তাদের পর্যাপ্ত সরঞ্জাম রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘ এবং দাতাদের বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করা উচিত।
ত্রাণ সহায়তা প্রদানকারী কর্মীরা মহামারীর সময়ে শরণার্থী শিবিরে কাজ করার কারণে তাদের শিবিরে প্রবেশের সময় চেকপয়েন্টগুলোতে হয়রানির এবং কক্সবাজারে ভোগান্তির স্বীকার হওয়ার কথাও জানিয়েছে। “আমরা আমাদের কর্মীদের কাছ থেকে চেকপোস্টগুলোতে পুলিশের দ্বারা ভীত সন্ত্রস্ত হবার বহু ঘটনা শুনেছি,” একজন সহায়তা কর্মী এইচআরডব্লিউকে বলেছেন। “আমাদের কিছু কর্মীদের তাদের বাড়ির মালিকদের দ্বারা উচ্ছেদ করা হয়েছে শিবিরে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্যে। এটি একরকমের বিপর্যয় কারণ তারাই একমাত্র জনবল যারা এই প্রাদুর্ভাব থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে।“
ইন্টারনেট এবং ফোন সেবার বিধিনিষেধগুলো ভুল তথ্যের বিস্তারকে সহায়তা করছে, যা শরণার্থীদের জরুরি চিকিৎসা সেবা নেওয়া থেকে বিরত করছে। শরনার্থীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে যদি তারা কোভিড-১৯ এর উপসর্গের খবর দেন তাহলে তাদেরকে “সরিয়ে নেয়া” হবে। একজন শরনার্থী বলেন, “এখানে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া একটি গুজব রয়েছে যে, যদি কারো মধ্যে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা যায়, তাহলে তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে এবং হত্যা করা হচ্ছে।“
মানবিক সহায়তা প্রদানকারী গোষ্ঠী মেডিসিন স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস (এমএসএফ) ক্লিনিকে আসা রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে বলে রিপোর্ট করেছে এবং তারা আশংকা করছেন যে এটি শরণার্থী শিবিরে অন্যান্য রোগের গুরুতর প্রাদুর্ভাবের দিকে নিয়ে যেতে পারে। “যখন মানুষের মধ্যে কোন উপসর্গ আছে, তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসছে না কারণ তারা ভীত যে তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হবে,” একজন সহায়তা কর্মী বলেছেন। “আমরা আমাদের ক্লিনিকে শ্বাসযন্ত্রে সংক্রমণজনিত রোগীর আগমনে স্বল্পতা লক্ষ্য করেছি।“
বেশ কয়েকজন শরনার্থী বলেছে যে, স্থানীয় ক্লিনিক থেকে জায়গা স্বল্পতার কারণে তাদের ফিরিয়ে দেবার পর কিংবা এমএসএফ (MSF) এ রেফার করার পর নিরাপত্তা বাহিনী চেকপয়েন্টেগুলোতে তাদের আটকে দেয় এবং শিবিরের বাহিরে অবস্থিত এমএসএফ (MSF) এর ক্লিনিকগুলোতে যাওয়ায় বাধা প্রদান করে। শিবিরের বাহিরে চিকিৎসা সেবা অন্বেষণকারী অন্যান্য শরনার্থীরা জানায় অসুস্থতা সম্পর্কিত প্রশ্ন করার সময় অফিসাররা তাদেরকে ভয় দেখিয়ে নিভৃত করেছিল অথবা স্থানীয় মানুষজনের কাছ থেকে বৈরী আচরণের মুখোমুখি হতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এইচআইভি সংক্রমিত আক্রান্তরা বলেছে তারা ঔষুধ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে কারণ এর জন্য তাদেরকে যাওয়ার পথে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে হয়। “ক্যাম্পের ভিতরে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী এখন নেই, কিন্তু আমি বাহিরে গিয়ে আমার ঔষুধ নিতে ভয় পাই কারণ আমার মনে হয় যেনো তারা [স্থানীয় বাসিন্দারা] আমাদের ঘৃণা করে এবং আমাদের আঘাত করবে যদি তারা বাহিরে আমাদের খুঁজে পায়,” একজন শরনার্থী বলেন। “নিরাপত্তা চেকপয়েন্টগুলো পেড়িয়ে যাওয়া আরেকটি বাধা।“
নারী এবং মেয়েরা ইতোমধ্যেই শিবিরের মধ্যে নিরাপদ প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে গুরুতর প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে, এবং বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত কোভিড-১৯ এর মোকাবেলায় সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে মানবিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাগুলো এবং কর্মীদের আহবানে মনোযোগ দেয়া।
জনস্বাস্থ্য বা জাতীয় জরুরি অবস্থার প্রয়োজনে চলাচল সীমাবদ্ধ করার জন্যে নেয়া যেকোনো পদক্ষেপ অবশ্যই আইনসম্মত, প্রয়োজনীয়, এবং সমানুপাতিক, সেই সাথে পক্ষপাতহীন হতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবিরে কোভিড-১৯ এর প্রস্তুতি বাড়ানোর জন্যে সর্বোত্তম অনুশীলন নির্দেশনা ব্যবহার করা।
“রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে কোভিড-১৯ এর বিস্তার নিয়ন্ত্রন রাখতে সময়ের বিপক্ষে দৌড়াচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু সরকারের নতুন বিধিনিষেধ বিষয়টিকে আরো খারাপ করে তুলতে পারে,” এডামস বলেছেন। “ইন্টারনেট সেবা বন্ধ এবং মৌলিক সেবাসমূহ মারাত্মকভাবে কমিয়ে আনার পরিবর্তে, সরকারের উচিত মানবিক সহায়তা প্রদানকারী গোষ্ঠীগুলোর সাথে কাজ করা যেন সাহায্য এবং সুরক্ষা সরবরাহ নিশ্চিত হয় যাদের এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে।“