(ব্যাংকক) - বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভীষণ ঘনবসতিপূর্ণ মেগা ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশের কক্সবাজারে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা, আজ প্রকাশিত একটি রিপোর্টে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ কথা বলেছে। ২০১৭ সালের অগাস্টে শুরু হওয়া বার্মিজ সেনাদের জাতিগত নির্মূল অভিযান থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের বন্যা ও ভূমিধ্বসের শিকার হওয়া উচিত নয় বরং বাংলাদেশে তাদের প্রলম্বিত অবস্থানকালে স্থায়ী ঘর এবং শিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ পাওয়া উচিত।
২০১৮ সালের মে মাসে কক্সবাজারে পরিদর্শনের ভিত্তিতে ৬৮ পৃষ্ঠার রিপোর্ট “‘বাংলাদেশ আমার দেশ নয়: মায়ানমারের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশা”’ প্রস্তুত করা হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ উল্লেখ করছে যে মেগা ক্যাম্পটি ভীষণভাবে ঘনবসতিপূর্ণ। যেখানে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে জনপ্রতি ৪৫ বর্গমিটার স্থানের কথা বলা হয়েছে সে তুলনায় শরণার্থী শিবিরে জনপ্রতি ব্যবহারযোগ্য স্থানের পরিমাণ গড়ে ১০.৭ বর্গমিটার । ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাসকারী শরণার্থীরা সংক্রমক রোগ, আগুন, সামাজিক অস্থিরতা এবং পারিবারিক ও যৌন সহিংসতার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের উচিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মেগা ক্যাম্পটির নিকটবর্তী উখিয়া উপজেলা যেখানে তুলনামূলকভাবে সমতল ও সহজে যাতায়াতযোগ্য এবং যা ছোট ও কমঘনবসতিপূর্ণ সে স্থানে সরিয়ে নেয়া।
“৭০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ন্যায্যভাবেই আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়িয়েছে, যদিও তারা এখনও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে,” রিপোর্টটির লেখক ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রিলিক বলেছেন। “বাংলাদেশের উচিত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করা, তাদের যথাযথ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং জীবনযাপনের জন্য শিবিরের বাইরে কাজকর্মের সুযোগ দেয়া।”
মায়ানমারের পূর্ববর্তী সহিংস ঘটনায় পালিয়ে আসা ২০০,০০০ সহ নতুন করে আগত রোহিঙ্গাদের অনেকেই কুতুপালং-বালুখালী বর্ধিত শিবিরে বসবাস করছে, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। অস্থায়ী ঘরগুলোকে মজবুতকরণ, তুলনামূলকভাবে নিরাপদ অবকাঠামো তৈরি করা, নিরাপত্তা পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য শরণার্থী ও সাহায্য সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শিবিরটির বাসিন্দারা দুর্যোগর্পূর্ণ আবহাওয়ার কারনে খুবই অসহায় অবস্থায় রয়েছে।
শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে রাজি করানোর জন্য মায়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ শিবিরগুলোকে অস্থায়ী হিসেবে উল্লেখ করে। ফলে স্থায়ী ঘর ও সাইক্লোন প্রতিহত করতে সক্ষম বাড়ি এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ কাজে, যা শরণার্থীদের দীর্ঘ মেয়াদী অবস্থানের ইঙ্গিত দিতে পারে, সরকার অনুমতি দেয়নি। এর ফলে শিবিরগুলোতে বসবাসের পরিবেশ খুবই শোচনীয়। শিবিরগুলোতে শিক্ষার সুযোগও খুবই অপর্যাপ্ত।
“আমি ভূমিধ্বসের ভয় নিয়ে বাস করছি,” খাড়া ঢালের ওপর অবস্থিত একটি ঘরে চার সন্তান নিয়ে বসবাস করা ২৬ বছর বয়সী একজন মা বলেছেন। “আমাদের ঘরটিকে ধ্বসে পড়া থেকে রক্ষার জন্য আমি নিয়মিত এর আশেপাশে বালুর বস্তা ফেলি। আমি নিরাপদ স্থানে যেতে চাই। আমি সারাক্ষণ এই কথাই ভাবি। স্থানান্তরের জন্য কেউ আমার সাথে কথা বলেনি বা প্রস্তাব করেনি।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, পরিবেশগত কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন কম ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে শরণার্থীদের একটি বড় অংশকে স্থানান্তর করা তাদের স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া শরণার্থীদের সাথে আলোচনা ও তাদের সম্মতি নিয়ে করতে হবে যাতে তাদের উদ্বাস্তু গ্রাম্য সমাজের অখন্ডতা রক্ষা করা যায় এবং তারা নিজেদের বৃহত্তর রোহিঙ্গা শরণার্থী গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ অক্ষুন্ন রাখতে পারে।
কক্সবাজার থেকে শরণার্থীদের জনবসতিহীন ভাসান চরে স্থানান্তরের জন্য বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও চীনা নির্মাণকর্মীরা চরটিকে প্রস্তুত করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক চিঠির জবাবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, শরণার্থীদের উপস্থিতি যেহেতু “সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত অবস্থাকে বিনষ্ট করছে” তাই সরকার খুব শিগগিরি ১০০,০০০ রোহিঙ্গাকে ভাসান চরে স্থানান্তর করবে। চরটিকে উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষা করার জন্য মজবুত বাঁধ দেয়া হবে। বাংলাদেশের মেঘনা নদীর বুকে মাত্র গত ২০ বছরে জেগে ওঠা ম্যানগ্রোভ ও ঘাসের চরটিকে শরণার্থীদের বসবাসের উপযোগী বলে মনে হয় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে একটি শক্তিশালী সাইক্লোনের উঁচু জলোচ্ছ্বাসে ভাসান চর সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে।
চরটিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ খুবই সীমিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবনযাপনের ব্যবস্থাও সংকুচিত হবার আশংকা আছে। ভাসান চরে এবং এর বাইরে শরণার্থীদের চলাচলের স্বাধীনতার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ভাসান চরের পরিবেশগত ঝুঁকি ছাড়াও সেখানে শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল করা হলে তাদেরকে অযথাই একঘরে করে রাখা হবে। আর তাদের চর ত্যাগের অনুমতি না দিলে চরটি একটি আটককেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।
ভাসান চর স্থানান্তরের একমাত্র বিকল্প নয়। বিশেষজ্ঞরা উখিয়া উপজেলায় ছয়টি সম্ভাব্য স্থান চিহ্নিত করেছেন যেখানে ১৩০০ একরের বেশি জায়গায় ২৬৩,০০০ মানুষের স্থানসংকুলান সম্ভব। এই স্থানগুলো কুতুপালং-বালুখালী বর্ধিত ক্যাম্পের পশ্চিমে সমুদ্রতীরের দিকে আট কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।
বাংলাদেশী পররাষ্ট্র দফতর বলেছে যে, বাংলাদেশ শরণার্থীদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের চেষ্টা করছে, তবে শরণার্থীদের নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বেচ্ছায় ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের মূল সমাধান”। মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই সংরক্ষিত বনভূমির ৬০০০ একর জমি শরণার্থীদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে এবং “আমাদের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর জন্য বিরাজমান ভূমি সংকটের” কারণে বিকল্প অন্য কোন স্থান নেই। তারা বলেছে, স্থানান্তরের জন্য সম্ভাব্য বিকল্প স্থান হলো ভাসান চর।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক প্রয়োজন পূরণের জন্য দাতা সরকার ও আন্তঃসরকারি সংস্থাগুলোর আন্তরিক ও সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহায়তা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মানবিক সংকটের কারণে উদ্ভূত অভাব পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে। একই সাথে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদ, সম্মানজনক ও স্থায়ী প্রত্যাবাসনের উপযোগী সব শর্ত পূরণের জন্য মায়ানমার সরকারের ওপর সমন্বিতভাবে নিয়মিত চাপ প্রয়োগ করে যেতে হবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যেসব শরণার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎকার নিয়েছে তাদের সবাই শর্তসাপেক্ষে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাদের নাগরিকত্ব প্রদান, রোহিঙ্গা পরিচয়ের স্বীকৃতি, তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ন্যায়বিচার, ঘর ও সম্পত্তি ফেরত দেয়া এবং নিরাপত্তা, শান্তি ও তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা।
ফ্রিলিক বলেছেন, “মায়ানমারের হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পালিয়ে আসার প্রায় এক বছর হতে চলল। এই সংকটের দায়ভার মায়ানমারের ওপর বর্তায়, যদিও এই বিপুল শরণার্থীদের প্রায় সমস্ত দায়িত্ব বাংলাদেশের ওপর পড়েছে।” “রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত সাম্প্রতিক নৃশংসতা ও যুগযুগ ধরে চলে আসা বৈষম্য ও নিপীড়নের বিষয়ে অর্থপূর্ণ কোনো ব্যবস্থা নিতে মায়ানমারের ব্যর্থতাই এই শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে বিলম্বের মূল কারণ।”