Skip to main content

বাংলাদেশঃ ইউনিয়ন ও গার্মেন্টস কর্মীদের বিচারের সম্মুখীন করা বন্ধ করুন

পোশাক সমিতির স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য ব্রান্ডগুলোর প্রতিস্রুতিবদ্ধ হওয়া উচিত

(নিউ ইয়র্ক) -২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মজুর ধর্মঘটের পর বাংলাদেশে ডজনখানেক পোশাক শ্রমিক এবং শ্রমিকনেতারা অন্যায় ও মিথ্যা মামলার সম্মুখীন হয়েছেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে আজ একথা বলেছে। বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা নির্বিচারে গ্রেফতারের হার দিন দিন বেড়েই চলছে- আরও নয়জন ইউনিয়ন আয়োজকদের ১০ই ফেব্রুয়ারী গ্রেফতার করা হয়েছে, তা নিয়ে এ পর্যন্ত গ্রেফতারের সংখ্যা সর্বমোট ৩৪ এ দাঁড়িয়েছে। 

২০১৬ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর আশুলিয়ার গার্মেন্ট কারখানাগুলোর সামনে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর অবস্থান, শ্রমিক ধর্মঘটের প্রতিক্রিয়ায় কারখানাগুলো পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর পুনরায় খোলা হয়।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত আটককৃত ব্যাক্তিদের অতিসত্বর মুক্তি দেয়া এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার করা।

২৫ শে ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তারিখে দেশের পোশাক রপ্তানি সমিতি দ্বারা আয়োজিত ঢাকা আপ্য়ারেল সামিটে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের বিভিন্ন ব্রান্ড এবং দাতাগোষ্ঠীদের উচিত  ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করার এবং  শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য  সরকারকে আহ্বান জানানো। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের সহকারী পরিচালক, ফিল রবার্টসন বলেন “শ্রমিকদের মজুরির অভিযোগ শোনার পরিবর্তে, কর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা এবং শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখানো- বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং সরকারকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছে, সেইসাথে ইন্ডাস্ট্রি দাবী করেছে যে তারা শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,” । তিনি আরও বলেন “বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত বিশ্বের বিভিন্ন পোশাক ব্রান্ডগুলো এবং দাতাগোষ্ঠীদের উচিত  সরকারের উপর চাপ প্রয়োগকরা যাতে তারা শ্রমিক এবং শ্রম অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলাগুলো প্রত্যাহার করে।” 

এক হাজারেরও বেশী পোশাকশিল্প শ্রমিকরা, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বাইরে ১১ -১৯ শে  ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। তারা আশুলিয়া শিল্প এলাকার আনুমানিক ২০টি কারখানা থেকে এসেছে যারা বিশ্বের বিভিন্ন ব্রান্ডের পোশাক সরবরাহ করে। স্থানীয় সংস্থা ও কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বেশীরভাগ শ্রমিকেরা সেসব কারখানা থেকে এসেছে যেখানে কোন ইউনিয়ন নেই। জাতীয় ইউনিয়ন ফেডারেশন এ ধর্মঘটের সাথে কোন ধরনের সম্পৃক্ততা অথবা পূর্ব ধারণার ব্যাপারটি অস্বীকার করছে। কিন্তু বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ এ ধর্মঘটগুলোকে ব্যবহার করে, জাতীয় ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতাদের এবং শ্রমঅধিকার কর্মীদের এ ধর্মঘট “পরিচালনা” ও “পরিকল্পনার” দায়ে গ্রেফতার করে। 

শ্রমিকদের মজুরির অভিযোগ শোনার পরিবর্তে, কর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা এবং শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখানো- বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং সরকারকে উপহাসের পাত্রে পরিণত করেছে, সেইসাথে ইন্ডাস্ট্রি দাবী করেছে যে তারা শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
Phil Robertson

Deputy Asia Director

শ্রমিকেরা বলেছেন তাদের অভিযোগগুলি উত্থাপন করার একমাত্র মাধ্যম হল ধর্মঘট। যখনই ইউনিয়ন আয়োজক ও শ্রমিকেরা এ আয়োজন করেন, তখন সরকার এবং স্থানীয় কারখানাগুলো প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে, শ্রমিকেরা সম্মিলিতভাবে নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে এবং তাদের অভিযোগগুলি যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে অক্ষম হন। 

এ ধর্মঘটর পেছনে শ্রমিকদের দাবী ছিল তাদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ৫,৩০০ টাকা ($৬৭ ইউএস ডলার) থেকে বাড়িয়ে ১৫,০০০ ($১৮৭) অথবা ১৬,০০০ ($২০০) করা। ২০১৬ সালে, ফেয়ার লেবার এসোসিয়েশন জানায় যে বাংলাদেশে কারখানা শ্রমিকদের আয় বিশ্বব্যাঙ্কের দারিদ্র সীমার নিচে। বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানি এসোসিয়েশন (বিজেএমইএ)  এবং  সরকার উভয়ই একটি মজুরি পর্যালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। রপ্তানি এসোসিয়েশন হাজারো শ্রমিকদের আটকে রাখা এবং ধর্মঘট শেষ করার জন্য  আশুলিয়ার প্রায় ৬০টি কারখানা কিছুদিনের জন্য বন্ধও রাখেন। 

২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে, বাংলাদেশ থেকে তৈরিকৃত পণ্যের দ্বারা পরিচালিত ২০ টি ব্রান্ড, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এইচ এন্ড এম, ইন্দিটেক্স, গ্যাপ, সিএন্ড এ, নেক্সট এবং প্রিমারক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মজুরি পর্যালোচনার প্রতি সমর্থন জানিয়ে লিখেছেন, এবং সেইসাথে ইউনিয়ন নেতা এবং শ্রমিকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। 

অধিকার আদায়ের দল জানিয়েছেন যে প্রায় ১০ টি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে কারখানার সম্পত্তি ধ্বংসের জন্য ১৫০ জন শ্রমিকের নামে এবং ১৬০০ “নামবিহীন” শ্রমিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ইউনিয়ন নেতা এবং আয়োজকদের পূর্ববর্তী মামলা সম্পর্কিত কারনে প্রশ্ন অথবা গ্রেফতার করা হয়েছে। এই দলগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের জানামতে ৩৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদের বেশীর ভাগই ইউনিয়ন নেতারা। তাছাড়াও, ইটিভি (একুশে টেলিভিশন)-র একজন স্থানীয় সাংবাদিককে ধর্মঘটের খবর প্রচারের কারনে গ্রেফতার করা হয়েছে। জানুয়ারির প্রথম দিকে একটি খবরের মাধ্যমে জানা যায় যে, এ সংখ্যাটি আরও বেশী, তারা বলেছে যে পুলিশ কমপক্ষে ৪৪ জনকে গ্রেফতার করেছে এবং ১৫৯ জন সন্দেহভাজনদের খুঁজছে। গ্রেফতারকৃতদের পূর্ণ তালিকা এবং তাদের কোথায় রাখা হয়েছে সে ব্যাপারে পুলিশ কোন তথ্য প্রকাশ করেনি। 

অধিকার আদায়কারী দল, আইনজীবী ও শ্রমিকদের সাক্ষাতকার এবং পুলিশের তথ্যের উপর ভিত্তি করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায় যে আশুলিয়ার ধর্মঘটের পর অনেক গ্রেফতারের ঘটনাগুলো, অপরাধের সত্যতা যাচাইের চেয়ে শ্রমিক আয়োজকদের বিরুদ্ধে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহারের দিকে ইঙ্গিত করে।  আশুলিয়ার ধর্মঘটের পর,  পুলিশ নির্যাতনের কিছু কৌশল আগেও কর্তৃপক্ষ দ্বারা মানবাধিকার সম্পর্কিত ও অসম্পর্কিত ব্যাপারে ব্যবহার করা হয়েছে। যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছেঃ 

  • ১৯৭৪ সালের তৎকালীন বিশেষ ক্ষমতা আইন থেকে অস্পষ্ট বা বাতিলকৃত অপরাধের উপর ভিত্তি করে গ্রেপ্তার;
  • অধিক সংখ্যক “অজানা” লোকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ ব্যবহার করে পুলিশের যেকোনো ব্যাক্তিকে গ্রেফতারের হুমকি দেয়া,  আটককৃতদেরকে বার বার গ্রেফতার করা যদিও তারা এই মামলার আসামি নয়, এবং জামিনের অনুমতি  দিতে অস্বীকার করা; 
  • "পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার" এর মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশ হাইকোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন করা, পার্শ্বিকভাবে শাস্তির একটি অংশ হিসেবে জোরপূর্বক আটকে রাখা; 
  • সুরক্ষার অধিকার লঙ্ঘন করে নির্যাতন, অথবা নিষ্ঠুর, অমানবিক এবং অন্যান্য অপমানজনক আচরণের মাধ্যমে জোরপূর্বক  স্বীকারোক্তি প্রতিহত করা; 
  • আটককৃত দুইজন কে পুলিশ কর্তৃক হত্যার হুমকি দেয়া এবং পরবর্তীতে দাবী করা যে পুলিশের সাথে গুলি বিনিময়কালে “ক্রস ফায়ারে” তারা নিহত হয়েছেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন গার্মেন্টস ইউনিয়ন ফেডারেশনের একজন কর্মকর্তাকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া; 
  • “তদন্তের” নামে কর্মী এবং শ্রমিকদের হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করা; 
  • তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০১৫ এর ৫৭ অধ্যাদেশের অধীনে সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা; 
  • হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে যে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের উচিত এ ফৌজদারি মামলাগুলো প্রত্যাহার করা এবং যে পুলিশ অফিসারেরা আশুলিয়া ধর্মঘটের পর জোরপূর্বক নিখোঁজ, অত্যাচার, মৃত্যুর হুমকি এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন, তাদের জবাবদিহি চাওয়া । 

একটি সংবাদ প্রতিবেদনের মতে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ছয়জন শ্রমিক নেতা এবং তাদের স্ত্রীদের ১লা জুলাই ২০০৯ সাল থেকে সকল ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্ট  সংক্রান্ত হিসাব চেয়ে ব্যাঙ্কগুলোর কাছে চিঠি লিখে।

এদিকে রবার্টসন বলেছেন “বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ শ্রমিক নেতা এবং শ্রমিকদের নির্বিচারে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে সন্দেহভাজনদের “অজানা” সংখ্যা পূরণ করতে বদ্ধ পরিকর” । তিনি আরও বলেন যে, “আশুলিয়া ধর্মঘটের পরে অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা ফৌজদারি মামলাগুলোতে একটি পরিচিত ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।” 

শ্রমিক, স্থানীয় শ্রম অধিকার সংস্থা এবং সংবাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী,আশুলিয়ার কিছু কারখানায় এ ঘটনার জের ধরে  আনুমানিক ১৫০০ জন কর্মীদের বৈষম্যমূলকভাবে ছাঁটাই অথবা কাজ থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়।  

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, দাতাগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত ব্রান্ডগুলোকে শ্রমিকদের সম্মান এবং অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে । তাদের উচিত  শ্রমিক নেতা, কর্মী এবং সাংবাদিকদের প্রতি সকল ধরনের হয়রানিমূলক আচরণ বন্ধ করা এবং সেইসাথে সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা।  

বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত ব্রান্ডগুলোর উচিত অ্যাসোসিয়েশন স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী ইউনিয়নগুলির সাথে বাধ্যতামূলক চুক্তি করা,  বাংলাদেশ অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটির নীতিমালা মেনে চলা,   শ্রমিক এবং ব্রান্ডের মধ্যে  বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি কার্যকর চুক্তি করা।

ব্রান্ডগুলোর বর্তমান নীতিমালা ইউনিয়নগুলোর বিরুদ্ধে কারখানার প্রতিবাদ প্রতিরোধে অকার্যকর। 

এরই মধ্যে, ব্র্যান্ডগুলিকে নিশ্চিত করতে হবে যাতে তাদের সরবরাহকারীরা, কর্মী প্রতিনিধিদের সাথে একটি সংশোধিত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেইসাথে  শ্রমিকদের পুনর্বহাল এবং মজুরি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যৌথভাবে  আলোচনায় বসে। 

ধর্মঘট ও তার পরবর্তী অবস্থার পূর্ণ বিবরণের জন্য, দয়া করে নিচে দেখুনঃ 

 

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প

বাংলাদেশ গার্মেন্টস শিল্প প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করে এবং প্রায় ২৫০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। কিন্তু দেশটির শ্রমিক অধিকার বারবার খর্ব করা হয়েছে ক্রমাগত নির্যাতনের মাধ্যমে যার অন্তর্ভুক্ত রয়েছেঃ মেয়াদপূর্তি মজুরি পর্যালোচনা, মজুরি চুরি, কারখানার ইউনিয়নীকরণ এবং আগুননিয়ন্ত্রণ ও ভবন নিরাপত্তার চরম অভাব।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ভবন ধ্বসের ঘটনা, যেখানে ১১০০ কর্মী নিহত এবং আরও ২০০০ কর্মী আহত হয়েছেন, বাংলাদেশ সরকার, বিশ্বব্যাপী ব্রান্ড এবং কারখানাগুলোকে বাধ্য করে আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং ভবন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে;  যার ফলশ্রুতিতে এ ক্ষেত্রে কিছু উন্নয়ন লক্ষ্য করা গেছে।  

২০১৬ সালে, ফেয়ার লেবার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের কারখানাগুলো পর্যালোচনা করে পায় যে, চায়না এবং ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের কারখানার গড় মজুরি এবং ক্রয় ক্ষমতা বিশ্বব্যাংকের দারিদ্রসীমার নিচে। চায়না ও ভিয়েতনামে গড় মজুরি দারিদ্র্য সীমার ২.৫ গুণ। 

আশুলিয়া ধর্মঘটের পর, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৩২ জন কর্মী, আশুলিয়ার বাসিন্দা এবং পথচারীর সাক্ষাতকার গ্রহণ করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের  ইউনিয়ন নেতা, অধিকার কর্মী ছাড়াও আইন বিশেষজ্ঞের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে এবং পুলিশ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র এবং সংবাদ প্রতিবেদনও পর্যালোচনা করে। সাক্ষাতকারগুলো তাদের সম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়েছে এবং নিরাপত্তার খাতিরে সব নাম গোপন রাখা হয়েছে। 

 

আশুলিয়া ধর্মঘট

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে ওয়িনডি আপ্প্রেয়ালে (যাদের কোন ইউনিয়ন নেই) ধর্মঘট শুরু হয়। ১১ থেকে ১৯ ডিসেম্বরের মধ্যে, বিভিন্ন কারনে অন্যান্য কারখানার কর্মীরাও এ ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেন। উসাহরনসরূপঃ ভাল মজুরির খোঁজে, একটি কারখানার প্রায় ৪০০ জন কর্মী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন যে তারা ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন কারন তারাও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যৌন হুমকি এবং অপমানজনক আচরণে এবং সম্প্রতি ইউনিয়ন গঠনের কারনে একজন কর্মীকে ছাঁটাই করার কারনে ক্ষুব্ধ। 

অন্যান্য কারখানার কিছু শ্রমিকরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে তারা ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছেন কারন  তাদের মালিক অথবা ব্যবস্থাপকেরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে যদি অন্য কারখানা মজুরি বৃদ্ধি করে, তবে তাদের মজুরিও বৃদ্ধি পাবে। কিছু ক্ষেত্রে কর্মীরা বলেছেন,  ব্যবস্থাপক এবং অন্যান্য মধ্য-শ্রেণীর কারখানা কর্মকর্তারা এ ধর্মঘটে অংশ নেবার জন্য তাদের উৎসাহিত করেছেন কারন তারা বিশ্বাস করেন যে যদি ধর্মঘট সফল হয় এবং কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধি পায় তাহলে তাদেরও বেতন বৃদ্ধি পাবে। 

এ সময়ে, ধর্মঘটের ব্যাপারে কিছু কারখানা মালিক ও জাতীয় ফেডারেশন ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে একাধিক আলোচনার আয়োজন করে উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) মজুরি পর্যালোচনাতে শ্রমিকদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং দাবী জানায় যে পূর্ববর্তী পর্যালোচনার ৫ বছর না হওয়া পর্যন্ত  ২০১৮ সালের মধ্যে সরকার আর কোন আদেশ দিতে পারে না, এবং সরকার তা মেনে নিয়েছে। যদিও, শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে যে সরকার বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ১৪০ক এর অধীন যে কোনো সময় মজুরি পর্যালোচনার  আদেশ দিতে পারে।

শ্রম অধিকার গ্রুপ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে যে এই বৈঠকে সরকারি কর্মকর্তারা ইউনিয়ন ফেডারেশন নেতাদের কারখানায় শ্রমিকদের  ফেরত পাঠাতে বাধ্য করার আদেশ দিয়েছেন, নেতাদের অভিমত সম্পূর্ণরূপে  উপেক্ষা করে। নেতারা জানিয়েছেন যে আশুলিয়ার ধর্মঘটকারী শ্রমিকদের উপর ইউনিয়ন নেতাদের প্রভাব খাটবে না কারন তাদের কোন ইউনিয়ন নেই। ২০ শে ডিসেম্বর  বিজিএমইএ কারখানা বন্ধ করে এ ধর্মঘট শেষ করে। 

এর মধ্যে, দগ্লিয়ান ফ্যাশন লিমিটেড, আশুলিয়ার একটি কারখানা যাদের নিবন্ধকৃত ইউনিয়ন আছে এবং যাদের শ্রমিকেরা  ধর্মঘটে অংশ নেয়নি, জানুয়ারি মাসে তাদের মজুরি বৃদ্ধি দাবী আদায় করে যৌথভাবে আলোচনার মাধ্যমে যা নভেম্বর মাসে শুরু হয়েছিল।  চূড়ান্ত চুক্তি অনুযায়ী  শ্রমিকদের জন্য বার্ষিক মজুরি শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে, বোনাসের নিয়ম  প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং একটি অভিযোগ গ্রহণের পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। 

 

নিখোঁজ এবং “গ্রেফতারের” কৌশল

আইনজীবী, শ্রম অধিকার সংস্থা এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, অনেক ইউনিয়ন নেতারা নিখোঁজ হয়েছেন। ২৪ ঘণ্টার বেশী সময় পর, পুলিশ তাদের আদালতে উপস্থাপন করে, তার আগে পুলিশ তাদের আনুষ্ঠানিক গ্রেফতার এবং আটকে রাখার ব্যাপারে কোন তথ্য প্রকাশ করেনিঃ 

  • সৌমন্ত কুমার দাস, সভাপতি, গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট আঞ্চলিক কমিটি; 
  • আহমেদ জীবন, সাধারণ সম্পাদক,  গার্মেন্টস শ্রমিক ফ্রন্ট; 
  • আল কামরান, সভাপতি, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটি;
  • শাকিল আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক,  স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন সাভার-আশুলিয়া-ধামরাই আঞ্চলিক কমিটি;
  • শামিম খান, সভাপতি, বাংলাদেশ তৃণমূল  গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশন;
  • মিজানুর রাহমান, টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশন; 
  • মোহাম্মদ ইব্রাহিম, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটি; 
  • রফিকুল ইসলাম সুজন, সভাপতি, গার্মেন্টস এন্ড ইনডাসটি শ্রমিক ফেডারেশন; 
  • জাহাঙ্গীর, সভাপতি, ডিজাইনার জিন্স লিমিটেড কারখানা ইউনিয়ন; 

 

নাযমুল হুদা, সাংবাদিক। 

২১ ডিসেম্বর সকালে আশুলিয়ার একটি থিম পার্কে  কারখানার পুলিশের সাথে বৈঠকের পর, সাতজন ইউনিয়ন নেতা নিখোঁজ হন। তাদের ফোন বন্ধ ছিল এবং আত্মীয়স্বজন এবং সহকর্মীদের ফোনের জবাবে পুলিশ কোন তথ্য সরবরাহ করেনি। পুলিশ বেসামরিক পোশাকে জাহাঙ্গীরের বাসায় রাতে প্রবেশ করে এবং তাকে তুলে নিয়ে যায়, জাহাঙ্গীরের স্ত্রীকে তাড়া প্রতিশ্রুতি দেয় যে ৩০ মিনিটের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। সে ফিরে আসেনি এবং তার কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলনা। পুলিশ তার অবস্থান সম্পর্কে তার  পরিবারকে কিছুই জানায়নি। 

২২ শে ডিসেম্বরের রাতে, পুলিশ আটজন শ্রমিক নেতাদের আদালতে উপস্থাপন করে। কারন  আটককৃত ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ সীমিত, তাদের আটকে রাখা আইনগত নয়। আইনজীবীরা বলেছেন, কমপক্ষে তাদের চারজন (কামরান, আহমেদ , রাহমান এবং ইব্রাহিম) কে - চোখ বেঁধে গোয়েন্দা বিভাগের একটি অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয়; একজনকে পেটানো হয় এবং অন্যজনকে “ক্রসফায়ারে” হত্যার হুমকি দেয়া হয় (পুলিশের সাথে মিথ্যা গুলি বিনিময়কালে হত্যা হওয়া)। 

আটককৃতদের আদালতে উপস্থাপনের আগে আইনজীবীর সাথে যোগাযোগের অনুমতি দেয়নি। পুলিশ ২২ শে ডিসেম্বর দায়েরকৃত  অভিযোগ নং ৩০/৫২৪ প্রেক্ষাপটে ধারণ করে যে আটজন নেতারা গোপন বৈঠক, লিফলেট বিতরণ, এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ধর্মঘট শুরু করার কথা “স্বীকার” করেছেন।  

২৩ শে ডিসেম্বর, পুলিশ সাংবাদিক হুদাকে সংবাদ সম্মেলন ডাকার আমন্ত্রণ জানায় এবং যখন তিনি এসে পৌঁছান, তাকে জোরপূর্বক পিটিয়ে পুলিশের গাড়ীতে তোলে এবং ভোর ৪ টা পর্যন্ত ঢাকার আশেপাশে ঘোরায়, এবং তাকে “ক্রসফায়ারে”  হত্যার হুমকি দেয়।  পরের দিন তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। আহমেদ জীবনকেও গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশ কর্মকর্তারা দেখা করার কথা বলে ২৭ শে ডিসেম্বর সকাল বেলা নিখোঁজ করে এবং পরের দিন আদালতে উপস্থাপনের আগ পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। 

 

দমনমূলক বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার

বিশেষ ক্ষমতা আইন অভিযুক্তের যথাযথ অধিকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানকে লঙ্ঘন করে। একজন নেতৃস্থানীয় অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন যে এই মামলাগুলি প্রথমবারের মতো এই গার্মেন্টস শ্রমিক ও ইউনিয়ন আয়োজকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে এ মামলা সাধারণত একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল দ্বারা দ্বারা পরিচালিত, যার ফলে নিয়মিত ফৌজদারি আদালতের জন্য জামিন প্রদান করা কঠিন।

পুলিশ কিছু শ্রমিক নেতাদের “নাশকতার” দায়ে অভিযুক্ত করে- একটি অপরাধ এত অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত যে এটি শ্রমিকদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যেকোনও অপরাধমূলক আচরণের জন্য অপব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণসরূপ, একজন ব্যাক্তি নাশকতামূলক অপরাধ করে যদি সে “উৎপাদন ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত বা কর্মক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ বা ... (একটি) কারখানার ক্ষতির কারন হয়।” 

অনুরূপভাবে, পুলিশ নয়জন শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছে "নৃশংস কাজ" করার জন্য, একটি অপরাধ যা বাতিল করা হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, একটি জাতীয় ইউনিয়ন ফেডারেশন, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ হাইকোর্টে বাতিলকৃত অপরাধগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছে, যাকে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয় এবং আদালত আহমেদ জীবন নামের একজন ইউনিয়ন নেতাকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটকে আদেশ দেয়। 

একজন শীর্ষস্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞ হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, পুলিশ বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রয়োগে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়কে লঙ্ঘন করে,যেখানে আদালত স্পষ্টভাবে বলেছে যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্ষতি হয়েছে, এমন অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইন ব্যবহার করা যাবে না কারন এটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা সম্পর্কিত অপরাধ হিসেবে গণ্য করে না। অধিকার সংগঠন এ আইন সম্পূর্ণরুপে বাতিল করার আহ্বান জানায়।

 

গ্রেফতার এবং পুনরায় গ্রেফতারের হুমকি

"অজ্ঞাত" ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করে পুলিশ শ্রমিক ও শ্রমিক নেতাদের ভয় দেখিয়েছে, যেকোনো ব্যাক্তিকে গ্রেফতারের হুমকি দিয়ে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ পূর্বের এবং প্রতিনিয়ত সংগঠিত এ কৌশলগুলো লিপিবদ্ধ করে রেখেছে। আশুলিয়া ধর্মঘটের ঘটনায় ১৬  হাজারেরও বেশি "অজানা" ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খোলা অভিযোগ,   ইউনিয়ন নেতাদের উপর নির্যাতনের জন্য করা হয়েছে, এদের মধ্যে কয়েকজনকে নয়টি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। সম্প্রতি, আদালত কর্তৃক জামিনে মুক্তি পাবার পরপরই পুলিশ জীবনকে গ্রেফতার করে। 

আশুলিয়ার ধর্মঘটের পরপরই  পুলিশ আরও তিনজন শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতার করে - আসাদুর জামান, গোলাম আরিফ, এবং রঞ্জু-তারা সকলেই বাংলাদেশ স্বাধীন গার্মেন্টস ইউনিয়ন ফেডারেশন নেতা ছিলেন এবং তাদের ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসের মামলার কারনে গ্রেফতার করা হয় যার সাথে ধর্মঘটের কোন সম্পর্ক নেই। এই মামলাগুলো ২০১৫ সালে গাজীপুরে ২০ দলীয় জোটের জাতীয় অবরোধের সময় দায়ের করা হয়েছিল যার নেতৃত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল । গ্রেফতারকৃতদের কেউই এই মামলার সাথে জড়িত ছিল না কিংবা তাদের আগে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। ১০ ই ফেব্রুয়ারী আরও নয়জন শ্রমিক আয়োজকদের ২০১৬ সালে অগাস্ট মাসে পুলিশের কাজে বাঁধা দেবার জের ধরে একইভাবে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৩ ই ফেব্রুয়ারী তাদের জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। 

 

মিথ্যা, অস্পষ্ট অভিযোগ

কারখানা কর্তৃক নয়টি অভিযোগ দায়ের করা হয় কিছু জানা এবং অনেক “অজানা” ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে, যাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। 

একজন শীর্ষস্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞ যিনি এই অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করেছেন, তিনি হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে বেশীর ভাগ অভিযোগগুলো অস্পষ্ট এবং দেখা যায় যে "একই ব্যক্তির নির্দেশে এফআইআর (পুলিশ প্রথম তথ্য প্রতিবেদন) প্রস্তুত করা হয়েছিল। পুলিশ শুধু তাদের নাম পরিবর্তন করেছে।” 

যেখানে সম্পত্তি ক্ষতির অভিযোগ আনা হয়েছে যেমনঃ  কারখানার দরজা, জানালা এবং মেশিনের ক্ষতিসাধন, সেখানে অভিযোগগুলোর সত্যতা যাচাই করা হয়নি।  হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে সাক্ষাতকার দেয়া কিছু কারখানা শ্রমিক যারা কারখানায় কাজ করা শুরু করে তাদের কেউই নতুন মেশিন স্থাপন করা অথবা সম্প্রতি ক্ষতিগ্রস্ত যন্ত্রপাতি মেরামতের জন্য কারখানা বন্ধের মত কোনও ঘটনা দেখেনি। স্থানীয় অধিবাসীরা বলে যে তারা কোনও লুটপাট বা সহিংসতার ঘটনা দেখেনি। অন্যদিকে, তারা বলেছে যে এলাকাগুলিতে প্রচুর পরিমাণে পুলিশ ছিল এবং তারা ব্যারিকেড তৈরি করে বাঁধা দেয়। 

এক মামলায় কারখানাগুলো অভিযোগ করে যে ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে শ্রমিকরা "অযৌক্তিক দাবি" করে এবং ধর্মঘটে যাবার ফলে কাজের ক্ষতিসাধন করে। শ্রমিকেরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে সেদিন অগ্নি সংকেত বাজায় কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের চলে যেতে বলেন। যারা কাজে ফেরত আসতে চেয়েছেন কর্তৃপক্ষ তাদের ফেরত আসার প্রয়োজন নেই বলে জানান।  শ্রমিকেরা আরও বলেন যে মধ্য-শ্রেণীর কারখানা কর্তৃপক্ষ ও ব্যবস্থাপকেরা তাদের কারখানা ছেড়ে যেতে এবং ধর্মঘটে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করেন- এই বলে যে যদি শ্রমিকেরা ধর্মঘটে অংশ নেন তাহলে ব্যবস্থাপদেরও বেতন বৃদ্ধি পাবে। 

একই কারখানার ব্যবস্থাপক তার অভিযোগে বলেন যে ১০ই  ডিসেম্বর সকাল ৮:৪৫ মিনিটে কিছু শ্রমিক সহিংস হয়ে পড়েন,অন্যায়ভাবে যন্ত্রপাতি ভাঙতে থাকেন এবং দরজা ও জানালার ক্ষতিসাধন করেন যার পরিমাণ প্রায় ১০ লক্ষ টাকা (১২,৪৯২ ইউএস ডলার )। যদিও শ্রমিকেরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে ১৯শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায়, সুপারভাইজাররা কমপক্ষে কয়েকজন শ্রমিককে পরদিন সকালে দেরিতে আসতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।এই শ্রমিকরা যখন এসে পৌঁছান, তখন দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং তাদেরকে বলা হয় যে  কারখানার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। 

অন্য একটি ঘটনায়, শ্রমিকেরা অভিযোগ দায়ের করেছেন যে ১৯শে ডিসেম্বর সকাল ৮:৪৫ মিনিটে ১৫ জন পরিচিত এবং ৪০ থেকে ৫০ জন নাম না জানা শ্রমিকেরা কর্তৃপক্ষকে ভয়ভীতি এবং পেটানোর পর  যন্ত্রপাতি এবং দরজা জানালার ক্ষতিসাধন করে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লক্ষ টাকা (৩,৭৭০ ইউএস ডলার) এবং প্রায় ২ লক্ষ টাকা (আনুমানিক ২,৫১৫ ইউএস ডলার) মূল্যের পোশাক লুট করে নিয়ে যায়। তারা আরও অভিযোগ করে যে শ্রমিকরা সেই ৪০  থেকে ৫০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিদের সাথে মিলে কারখানার বাইরে রাস্তায় দাঁড়ান গাড়ি ভাংচুর করে। তারা বলেছে যে এর জের ধরে কয়েক দিন কারখানা বন্ধ রাখা হয়। 

কারখানা শ্রমিকেরা হিউম্যান রাইটস ওয়াকে বলেছেন যে ১৯শে ডিসেম্বর কর্তৃপক্ষ লাউডস্পিকারে কারখানা বন্ধ করা এবং শ্রমিকদের বাড়ি যাবার আদেশ দেয়। শ্রমিকেরা অভিযোগ করে চলে যায়  এবং বলেছেন যে বাড়ি যাবার সময় তারা কোন প্রকার সহিংসতার চিহ্ন দেখেননি।  চরমভাবে ক্ষতির অভিযোগ আনা সত্ত্বেও, যে শ্রমিকেরা কারখানা পুনরায় খোলার পর  ভেতরে কাজ করা শুরু করেন, বলেছেন যে  তারা নতুন যন্ত্রপাতি স্থাপন কিংবা যন্ত্রপাতি মেরামত করা অথবা যন্ত্রপাতির ক্ষতি কিংবা কোন প্রকার ক্ষতির খবর শোনেননি। 

 

পুলিশ দ্বারা শ্রমিক কর্মীদের হয়রানি এবং বিআইজিইউএফ নেতাদের মৃত্যুর হুমকি

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, সংহতি কেন্দ্র যারা শ্রমিক এবং ইউনিয়নের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, তারা কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ করে যেখানে ১৪টি জাতীয় ইউনিয়নকে তাদের আশুলিয়া, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের অফিস বন্ধ করার জন্য পুলিশ বাধ্য করে অথবা পুলিশের হয়রানির জন্য তারা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। 

বাংলাদেশ স্বাধীন গার্মেন্টস ইউনিয়ন ফেডারেশন (বিআইজিইউএফ) কর্তৃক লিখিত ঘটনার তথ্য অনুযায়ী ২০শে জানুয়ারি দুই সাধারণ পোশাক পরিহিত পুলিশ গাজীপুর কার্যালয়ে আয়োজিত এক আইএলও-স্পন্সর স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বাধা দেয়, দুই বিআইজিইউএফ আয়োজকদের সাথে দেখা করতে দাবী জানায়। আরো পুলিশের পোশাক পরিহিত কর্মকর্তারা চত্বরে প্রবেশ করেন, সেমিনার রুমে সকল বিজিইউএফ কর্মী ও কর্মসূচি অংশগ্রহণকারীদের একত্র করে, তাদের ব্যক্তিগত বিবরণ উল্লেখ করে, এবং সতর্ক করে দেন যে তারা যেন বিআইজিইউএফের কর্মকাণ্ডে অংশ না নেন। বিআইজিইউএফ-এর মতে, এক পুলিশ সদস্য ইউনিয়ন ফেডারেশনের সহ-সভাপতি, রুশুল আলম রাজু যিনি রুমে ছিলেন না, তাকে এই বলে হুমকি দেয় যে তাকে ধরা হলে নালার পানিতে ডুবিয়ে মারা হবে। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অতীতে এ ধনের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছে। ২০১০ সালে, পুলিশ বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সলিডারিটি সেন্টারের  (বিসিডব্লিউএস) কর্মীদের আটক এবং হয়রানি করে। বন্দীদের একজন, আমিনুল ইসলাম, অন্য অধিকার সংগঠনকে জানান যে পুলিশ তাকে নির্যাতন ও হত্যার হুমকি দিয়েছে। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে আমিনুল নিখোঁজ হন এবং অবশেষে তার মৃতদেহ পাওয়া যায় যেখানে অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল যা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সম্পৃক্ততা ব্যাপারে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। আজ পর্যন্ত, পুলিশ সন্দেহভাজনদের খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছে, এবং কর্মকর্তারা একটি স্বাধীন তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক অধিকার গ্রুপ এবং সাহায্যকারী দাতাদের আহ্বান জানায়নি।

 

প্রতিশোধমূলক ছাঁটাই, কারখানা শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা 

অধিকার গ্রুপ এবং সংবাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কারখানার ব্যবস্থাপকেরা ধর্মঘটের পর আশুলিয়ার আনুমানিক ১৫০০ জন শ্রমিকদের ছাঁটাই  করেছে। কিছু শ্রমিকেরা হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন যে তাদের কারখানা ব্যবস্থাপকেরা তাদের বাড়িতে গ্রামে একটি শো-কজ নোটিশ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু তারা কোনো তথ্য পায়নি। অন্য শ্রমিকরা বলছেন যে কারখানার কর্মকর্তা বা সুপারভাইজাররা তাদের ফোনে বলেছেন যে তারা কারখানার কাছে আসতে পারবে না, আসলে তাদের গ্রেফতার করা হবে কোন কারন ছাড়াই। একটি তৃতীয় দল বলেছে যে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের একটি যথাযথ শো-কজ নোটিশ দিয়েছে, যেখানে তারা সাত দিনের মধ্যে এই অভিযোগের দায় স্বীকার  করবে এবং বলবে যে তারা সহিংস ধর্মঘটের অংশগ্রহণ করেছিল বা প্ররোচিত করেছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই কয়েকটি নোটিশ দেখেছে। কোনো নোটিশ একজন ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করা পাঠানো হয়নি, কিংবা তারা কিভাবে এ ধর্মঘটের সাথে জড়িত ছিল তা বলা হয়নি বরং শ্রমিকদের একটি গ্রুপের কাছে অস্পষ্টভাবে অভিযোগগুলি করা হয়েছিল। 

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে এ প্রতিশোধকমূলক ছাঁটাই ও বরখাস্ত বৈষম্যমূলক। কারখানার কর্তৃপক্ষ সুবিধাবাদীভাবে ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের "অকর্মঠ" বা "সমস্যা নির্মাতা" হিসেবে বিবেচনা করে। একজন গর্ভবতী শ্রমিক বলেন যে তার গর্ভাবস্থার কারণে কোনও ধর্মঘটে অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। একজন পুরুষ কর্মীকে অসুস্থতার কারণে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং একজন মহিলা কর্মী বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে কর্মস্থলে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার কারনে তাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়।  

 

একজন বহিস্কারকৃত শ্রমিক বলেন, অন্য কারখানাগুলিতে চাকরি খোঁজা এখন অসম্ভবঃ 

আমার জীবন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে...এ ঘটনার পর আমি বেশ কয়েকটি কারখানায় চাকরি করার চেষ্টা করেছিলাম।  জানুয়ারিতে, আমি এনভয় গ্রুপে যোগদান করেছিলাম এবং প্রায় আধা ঘন্টা কাজ করেছি। কিন্তু একজন কর্মকর্তা এসে বললেন যে আমাকে নিয়োগ করতে পারবেন না, কোনও কারন ছাড়াই। পরে একজন নিরাপত্তা রক্ষী আমাকে বলেন যে আমাদের ছবি অন্য কারখানাগুলিতে ইমেল করা হয়েছে এবং তার মাধ্যমে তারা আমাকে সনাক্ত করেছে। আমি আশুলিয়া এলাকা ছেড়ে যাবার চিন্তা করছি, কিন্তু আমি জানি না আমি অন্য এলাকায় চাকরি পাব কিনা। এ এলাকা ছেড়ে যাবার আগে আমার ঘরভাড়া ও অন্যান্য বিল পরিশোধ করতে হবে।

 

ইউনিয়ন-আক্রমণ

সরকারি তথ্য অনুযায়ী আগস্ট ২০১১ থেকে আশুলিয়ার ২৩ টি কারখানায় ইউনিয়ন নিবন্ধিত হয়েছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ দ্বারা আশুলিয়ায় ইউনিয়ন গঠনের উদ্যোগ ব্যাহত করার অনেক উদাহরণ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিপিবদ্ধ করে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাপী পোশাকের ব্র্যান্ডের সরবরাহ কারখানায় ইউনিয়নের অনিয়ন্ত্রিত অবস্থা শ্রম অধিকারকে ঝুঁকির সম্মুখীন করছে।

এক ইউনিয়ন ফেডারেশন নেতা বলেন যে "অংশগ্রহণকারী কমিটি" - বাংলাদেশ শ্রম আইনের অধীনে নিয়োগকর্তা-কর্মী কমিটি -  কারখানার ইউনিয়নগুলিকে বদলে দিতে শুরু করেছে। আশুলিয়ার বিভিন্ন কারখানার কয়েকজন কর্মচারী জানান, তাদের কারখানা "ইউনিয়ন” গঠনের অনুমতি দেয়নি কিন্তু এই কমিটির প্রতিনিধি বাছাই করার জন্য শ্রমিকদের ভোট দেয়ার অনুমতি দিয়েছে। সলিডারিটি সেন্টার হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছে যে কমিটিগুলি কেবল কাগজে প্রকাশিত হয় বা নিয়োগকারীদের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব করে না।

একটি কারখানার একটি ইউনিয়ন অফিসের কর্মী বলেন: "আমাদের কারখানায় ইউনিয়নের নিবন্ধন তিন মাস আগে পেয়েছিলাম। মালিক যখন এই বিষয়ে অবগত হন, তখন তিনি ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি সহ ৭৪ জন শ্রমিককে বরখাস্ত করেন ... এখন আমি সহ আরও ১৫০ জনকে বরখাস্ত করেছে, যদিও সাম্প্রতিক প্রতিবাদে আমার কোনো ভূমিকা নেই।” অন্য মামলায়, শ্রমিকরা তাদের কারখানাটিতে তিনবার ইউনিয়ন গঠন করার চেষ্টা করেছিল, শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য।  

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country