অনেক ধনী রাষ্ট্র যখন তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে তখন বাংলাদেশ তার সীমান্ত উন্মুক্ত রাখার জন্য ন্যায্যভাবেই প্রশংসিত হয়েছে। গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে মায়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর জাতিগত নিধন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরর্ণাথীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য দ্রুত সম্প্রসারণ করা শিবিরটি শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ,পর্যাপ্ত বা টেকসই নয়। খাড়াঢালের ওপর নির্মিত কয়েক লক্ষ ঠুনকো ঘরগুলোকে হঠাৎ ধ্বসে যাওয়া বা বৃষ্টিজল মিশ্রিত হয়ে কাদা-মাটির ক্ষয় থেকে প্রতিরোধ করার জন্য সেখানে কোনো গাছ বা ঝোপঝাড় নেই।
নতুন করে আগত এই শরণার্থীরা মায়ানমারের অতীতের নির্যাতন থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারে অবস্থানকারী ২০০,০০০ শরণার্থীদের সাথে যোগ দিয়েছে। আর স্বল্পসংখ্যায় নিরবচ্ছিন্নভাবে শরণার্থীদের আগমন অব্যাহত রয়েছে, এই বছর এখন পর্যন্ত ১১,৫০০ শরণার্থী তাদের জীবনের হুমকির আশংকায় পালিয়ে এসেছে। খুবই ঘনবসতিপূর্ণ শিবিরটিতে জন প্রতি ব্যবহারযোগ্য স্থানের পরিমাণ গড়ে ১০.৭ বর্গমিটার যেখানে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে শরণার্থী শিবিরে জনপ্রতি ৪৫ বর্গমিটার স্থানের কথা বলা হয়েছে। এই অবস্থায় শিবিরে বসবাসকারী মানুষগুলো সংক্রামক রোগ, অগ্নিকাণ্ড,সামাজিক অস্থিরতা এবং পারিবারিক ও যৌন সহিংসতার উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছে যে শিবিরগুলো অস্থায়ী এবং শরণার্থীরা খুব তাড়াতাড়ি নিজ ঘরে ফিরে যাবে। স্বেচ্ছায় শরণার্থী প্রত্যাবাসন যাতে সম্ভবপর হয় সেজন্য উপযুক্ত আবহ তৈরির জন্যও মায়ানমার সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ এই কথা বলে। এই কথার ওপর গুরুত্বারোপ করার জন্যই বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য স্থায়ী ঘর এবং সাইক্লোন সহনশীল বাড়ি বা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে বাধা প্রদান করে,কারণ এ পদক্ষেপগুলো শরণার্থীদের স্থায়ী বা দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের বিষয়ে ইঙ্গিত দিতে পারে।
কিন্তু এর ফলাফল অধিবাসীদের জীবনের ওপর হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। দ্রুততার সাথে এবং অপরিকল্পিত ভাবে মেগা ক্যাম্পটি নির্মাণের ফল হলো ঘরগুলোর অনুপযুক্ত অবস্থান,ত্রুটিপূর্ণ রক্ষণাবেক্ষণ,অপর্যাপ্ত ও মানহীন শৌচাগার এবং রোগ-বালাইয়ের উচ্চ ঝুঁকি। জাতিসংঘের যৌথ সহায়তা কর্মসূচি ২০১৮-তে (Joint Response Plan-JRP) উল্লেখ করা হয়েছে যে শৌচাগার গুলো ব্যবহারযোগ্য পানির উৎস,ঘর ও খাড়া ঢালের খুব কাছে নির্মাণ করা হয়েছে এবং শৌচাগারগুলোর গর্ত নূন্যতম পাঁচ ফুট গভীরতায় তৈরি করার বাধ্যবাধকতা অনেক ক্ষেত্রেই মানা হয়নি। এর ফলে উৎসের পানির নমুনার ৫০ শতাংশ এবং গৃহস্থালী ব্যবহারের পানির নমুনার ৮৯ শতাংশ দূষিত বলে পাওয়া গেছে।
পাঁচ সন্তানের ২৩ -বছর বয়সী জননী,যার মেয়ে মায়ানমার থেকে পালানোর সময় বহুবার গুলিবিদ্ধ হয়েছে, এখনো ভীতির মধ্যে বসবাস করছে। “এখানে নিরাপদ সুপেয় পানির কোনো ব্যবস্থা নেই” সে আমাকে জানিয়েছে। “শৌচাগারগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়। আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই কারণ এ স্থান নিরাপদ নয়। রাতে আমার ভয় লাগে। প্রায় রাতেই আমি গুলির শব্দ শুনতে পাই। আমি আশংকা করি যে এখানে ভূমিধ্বস হতে পারে কারণ আমরা এখানে খাড়া ঢালের ওপর বাস করছি। বৃষ্টির সময় আমাদের ঝুপড়ির ভেতর পানি ঢুকে যায়। ঝুপড়িটিকে পানিতে ভরে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য আমরা সারাক্ষণ বাঁধ দিতে থাকি। কিন্তু বাঁধ বলতে কেবলমাত্র বালুর বস্তা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে।”
বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য দাতা সরকারগুলোকে আন্তরিকতার সাথে ও সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন ও সহায়তা করতে হবে। কিন্তু তারা তা করছে না। রোহিঙ্গা সংকটের মানবিক প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য জাতিসংঘের এই বছরের আর্থিক আবেদনের মাত্র এক তৃতীয়াংশ অর্থায়ন হয়েছে। সবচেয়ে কম অর্থায়ন প্রাপ্ত খাতের তালিকায় শীর্ষে খাদ্য (১৮ শতাংশ), স্বাস্থ্য (১৭ শতাংশ), বাসস্থান (১৬ শতাংশ) এবং পানি, স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা (১৪ শতাংশ)।
শরণার্থীদের দ্রুত নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাবার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বারোপের আরেকটি ফলাফল হয়েছে শিশুরা “স্কুলে” না গিয়ে “অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্রে” যাচ্ছে যেখানে “শিক্ষকরা” নয় বরং “সহায়তাকারীরা” স্কুলে যাবার উপযোগী শিশুদের কেবল এক-চতুর্থাংশকে প্রাথমিক শিক্ষা দিচ্ছে। এই শিক্ষাকেন্দ্রগুলো দিনে দুই ঘন্টা করে কেবলমা্ত্র প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের প্রারম্ভিক পাঠ দেয়। স্কুলে যাবার জন্য উপযুক্ত প্রায় ৪০০,০০০ শিশু ও কিশোর রয়েছে। আর কিশোরদের উপযোগী শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাই নেই।
আমি যেসব শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি তাদের সবাই মায়ানমারে ফিরে যেতে চেয়েছে। তবে কিছু শর্তপূরণসহ সার্বিক পরিস্থিতি ফিরে যাবার অনুকূল হলেই তারা স্বেচ্ছায় ফেরত যাবার কথা বলেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো তাদের নাগরিকত্ব প্রদান,তাদের রোহিঙ্গা পরিচয়ের স্বীকৃতি,তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের ন্যায়বিচার, ঘর ও সম্পত্তি ফেরত দেয়া এবং নিরাপত্তা,শান্তি ও তাদের অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা।
রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের মূল কারণ মায়ানমারের গণহত্যা,ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ। এ অভিযানের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির একবছর পূর্তিতে ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সাম্প্রতিক নৃশংসতা অথবা যুগ যুগ ধরে তাদের বিরুদ্ধে চলে আসা বৈষম্য ও নিপীড়নের বিষয়ে অর্থপূর্ণ কোনো ব্যবস্থা নিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচি সহ মায়ানমারের নেতৃত্বের ব্যর্থতাই এই শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের বিলম্বের মূল কারণ।
বাংলাদেশ ও বাকি বিশ্বের উচিত মায়ানমারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বেচ্ছায় নিরাপদে ও সম্মানের সাথে প্রত্যাবাসনের অধিকারের জন্য চাপ দেয়া। একইসাথে বাংলাদেশকে এটাও মানতে হবে যে এটি খুব শীঘ্রই হবার নয়। বাংলাদেশের উচিত মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত করা, তাদের যথাযথ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা এবং খাদ্য,পানি ও পয়ঃব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং তাদের চলাচলের স্বাধীনতা সম্প্রসারিত করা যাতে তারা ক্যাম্পের বাইরে এসে জীবনধারণের জন্য কাজকর্মে নিয়োজিত হতে পারে।
শরণার্থীদের মানবিক প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য দাতা সরকারগুলোকে কেবল বাংলাদেশে প্রদত্ত সহায়তার পরিমাণ বাড়ালেই হবে না,বরং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে মৌলিক সংস্কার এবং গতবছরের জাতিগত নিধন অভিযানের বিপরীতমুখী যাত্রার উদ্দেশ্যে সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মায়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।