(নিউ ইয়র্ক) – হিউম্যান রাইটস ওয়াচ আজ বলেছে, ন্যয়বিচারের মানদণ্ড গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর) বিদ্রোহে হত্যা, যৌন নির্যাতন এবং অন্যান্য নৃশংসতায় অভিযুক্ত ৮৪৭ জন সামরিক কর্মকর্তার পুনঃবিচারের আদেশ দেয়া উচিত।
আসন্ন ৩০ অক্টোবরের রায় সহ, যেখানে মৃত্যুদণ্ড আরোপ করা হতে পারে, এবং বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়া ও রায় উভয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও স্বাধীনভাবে যাচাইয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কমিশন গঠন করা উচিত। এরপর আরো গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া আরাম্ভ করা উচিত।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস বলেছেন, “এক বিশাল আদালত ঘরে শত শত মানুষকে একসাথে বিচার করা যেখানে অভিযুক্তর সামান্য বা কোনই আইনজীবীর সহায়তা পাওয়ার অধিকার নেই তা আন্তর্জাতিক আইনী মানদণ্ডরে প্রকাশ্য অপমান।
“কর্তৃপক্ষের বরং উচিত অবিলম্বে বিশ্বাসযোগ্য ও ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়া আরম্ভ করা যেন বিদ্রোহে ক্ষতিগ্রস্তরা ও তাদের পরিবার ন্যায় বিচার পায়।”
পুলিশ হেফাজতে রেখে নির্যাতন এবং অন্যান্য অপব্যবহারের মাধ্যমে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি ও এজাহার আদায় করা ন্যায্য বিচার প্রক্রিয়ার মানদণ্ডের লঙ্ঘন। অন্তত ৪৭ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তি পুলিশ হেফাজতে মারা গেছেন। উপরন্তু, বিডিআরে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আইনজীবীর সহায়তা পাওয়ার এবং তাদের বিরুদ্ধে গঠিত অভিযোগ ও প্রামাণিক তথ্য সম্পর্কে জানার সীমিত অধিকার ছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১২ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত ৫৭ পৃষ্ঠার এক রিপোর্ট এবং বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা বিবৃতির মাধ্যমে এ সব অপব্যবহার নথিভুক্ত করেছে।
২০০৯ এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদস্যরা ঢাকার পিলখানা ব্যারাকে বিডিআরের কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরে তাদের কমান্ডিং অফিসারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং তখন থেকে এটির নতুন নামকরণ করা হয়- বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডস। মনে করা হয় যে নিম্নপদস্থ সৈনিকদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ বিডিআর বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটায়, যাতে ৫৭ জন সামরিক কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন মানুষ নিহত হয়। সামরিক কর্মকর্তাদের বেশ কজন নারী আত্মীয় যৌন নির্যাতনের স্বীকার হন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে সামরিক-বেসামরিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারের মানদণ্ড অনুযায়ী সম্পন্ন হয়নি, যদিও এসব নৃশংস হিংস্রতার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা জরুরি।
তৎকালিন সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিডিআর বিদ্রোহ শেষ করার জন্য আপস করেন। কিন্তু বিদ্রোহকারীরা আত্মসমর্পণ করবার পর কর্তৃপক্ষ ৬০০০ এর বেশি বিডিআর সদস্যকে গণ গ্রেপ্তার করে। এইসব বিডিআর ব্যাটেলিয়ন সদস্যদের একসাথে এমন কি কয়েক শতকে এক সাথে বিচার করা হয়। বেশিরভাগ বিচারই বিডিআর-এর নিজস্ব আইনের আওতায় করা হয়, যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল সাত বছরের কারাদণ্ড। যদিও আরো ৮৪৭ জন বিডিআর সদস্যকে বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনে আওতায় বিচার করা হয়; যে আইনে তাদের কোন কোন অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়।
বন্দীদের পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয় মিডিয়া নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর মত গুরুতর অভিযোগ আনে। প্রায়ই বন্দীদের পদতলে অথবা হাতের তালুতে মারধোর করা হত এবং বৈদ্যুতিক শক দেয়া হত। কিছু নির্যাতিত ব্যক্তি তাদেরকে ছাদ থেকে উলটা করে ঝুলিয়ে রাখার বর্ণনা দিয়েছেন। বেশ কজন বেঁচে থাকা নির্যাতিত ব্যক্তি কিডনি ক্ষয় ও আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্থতাসহ অন্যান্য দীর্ঘ মেয়াদী শারীরিক অসুস্থতা ভোগ করেছে। যদিও সরকার-দলীয় আইনজীবী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছিল যে নির্যাতনের মাধ্যমে সংগৃহীত প্রমাণাদি বিচার প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা হবে না, কিন্তু বিবাদি পক্ষের আইনজীবীর মতে তার মক্কেলদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত প্রমাণাদির আংশিক অংশ নির্যাতনের মাধ্যমে সংগৃহীত বিবৃতিগুলো থেকে ব্যবহার করা হয়েছে।
এইসব গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নিয়মতান্ত্রিক বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণের পরিবর্তে সরকার ওই সব আপত্তি বাতিল করে দেয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষর একটি স্বাধীন টাস্ক ফোর্স গঠন করার আহ্বান জানাচ্ছে, যার কঠোর তদন্ত করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে দক্ষতা, কর্তৃত্ব এবং অর্থ থাকবে এবং যা সব আইনবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন ও বিডিআর বিদ্রোহে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগের উপযুক্ত বিচার করবে।
“নির্যাতন বাংলাদেশে নিয়মিত ব্যাপার এবং সরকার যদি বিডিআর বিদ্রোহের সন্দেহভাজনদের উপর বিশ্বাসযোগ্য নির্যাতনের অভিযোগ এভাবে উপেক্ষা করতে থাকে তাহলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর এই দায় মুক্তির সংস্কৃতি চলতেই থাকবে।” অ্যাডামস বলেন। “বাংলাদেশ সরকার নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার অসহনশীলতা শুধু প্রচারই করে, কিন্তু এই কথা বাস্তবায়ন করতে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।”
এছাড়া হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে ইতিমধ্যে বিচার সম্পন্ন হওয়াগুলোসহ বিডিআর বিদ্রোহের বিচারধীন সব মামলার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছে। ৮৪৭ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় বিদ্যমান ন্যায় বিচার নিয়ে উদ্বেগকে আরও বৃদ্ধি করে, বিশেষত যখন বিচার প্রক্রিয়ার প্রমাণাদি নির্যাতনের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করে যে কোনো মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় একটি নিষ্ঠুর এবং অপরিবর্তনীয় শাস্তি।