(ওয়াশিংটন, ডিসি) - বাংলাদেশ সরকার শত শত সক্রিয় কর্মী, সমালোচক এবং বিরোধী দলীয় সদস্যদের জোরপূর্বক গুমের সাথে জড়িত থাকার কথা ক্রমাগত অস্বীকার করে আসছে এবং এ সকল ঘটনার তদন্তের কোন রকম পদক্ষেপ নেয়নি, ৩০শে আগস্ট, জোরপূর্বক গুমের শিকার মানুষদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ কেনেডি হিউম্যান রাইটস, এবং এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন বলেছে। জোরপূর্বক গুম হওয়া এবং অন্যান্য গুরুতর অপব্যবহারে জড়িত শীর্ষ নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডারদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিদেশী সরকারের উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত।
২০২১ সালের আগস্টে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে ২০০৯ সাথে থেকে ২০২০ ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপকভাবে জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন গণমাধ্যমকে এই অভিযোগগুলি “বানোয়াট” বলে অভিহিত করে এই প্রতিবেদনের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে গুম হওয়ার ব্যাপারে সরকারের জড়িত থাকার জোরালো প্রমাণ অস্বীকার করে আসছে, যা বিশেষ করে ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য ক্ষতিকর এবং বেদনাদায়ক।
“বাংলাদেশ সরকার শত শত জোরপূর্বক গুমের ঘটনায় তার নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা তদন্তে একেবারেই কোন আগ্রহ দেখায়নি,” বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস। "দায়ী বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, বিদেশে থাকা সম্পদ এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিষেবার ব্যবহারের উপর যেন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হন তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারগুলোর কাজ করতে হবে।"
জোরপূর্বক গুম হওয়াকে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা বা তাদের এজেন্টদের দ্বারা একজন ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার বা আটক করার পরে তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্ছিত হবার বিষয়টি স্বীকার, অথবা ব্যক্তির পরিণাম বা অবস্থান প্রকাশ করাকে প্রত্যাখান করা। জোরপূর্বক গুম হওয়া অনেক গুলো মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, যার মধ্যে রয়েছে নির্বিচারে আটক, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, দেশের অন্য যে কোন নিরাপত্তা বাহিনীর ইউনিটের তুলনায় কুখ্যাতভাবে অবমাননাকর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বাংলাদেশে বেশিরভাগ জোরপূর্বক গুম হওয়ার ঘটনার সাথে যুক্ত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ র্যাবকে একটি "ডেথ স্কোয়াড" হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং বারবার এটিকে ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছে।
সরকারী নেতৃত্বের প্রত্যাখানগুলো পদবী অনুসারে ধাপে ধাপে নিচের দিকে নেমে এসেছে, মানবাধিকার দলগুলো বলেছে। অনেক পরিবার যাদের প্রিয় মানুষ গুলোকে জোড়পূর্বক গুম করে দেয়া হয়েছে, তারা বলেছে যে যখন তারা একটি পুলিশ রিপোর্ট দায়ের করতে গিয়েছিল, পুলিশ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গুলো নিতে অস্বীকার করেছিল এবং যার ফলে কিছু পরিবার হুমকি ও হয়রানির শিকার হয়েছিলেন।
ইসলামিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের একজন সক্রিয় কর্মী রেজাউন হোসেনের পরিবার বলেছিল যে, ২০১৬ সালের ৪ঠা আগস্ট তারিখে পুলিশ হোসেনকে আটক করার পর, তাকে আটক রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেছিল, এবং তারা স্থানীয় থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করার চেষ্টা করেছিল। তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাদের বলেছিলেন, “রেজাউনকে খোঁজা বন্ধ করুন নতুবা আমরা তোমাদের সবাইকে হত্যা করবো।“ হোসেন জোড়পূর্বক ভাবে গুম হয়ে আছেন।“যদি আমার ছেলে অপরাধী হয়ে থাকে,তাহলে পুলিশ তাকে আদালতে হাজির করতে পারে,” তার মা, সেলিনা বেগম বলছিলেন। “পুলিশ কেন তাকে তুলে নিয়ে গেল এবং গুম করে দিলো?”
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং অন্যান্য দেশ গুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং ভিসা বা প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, সম্পদ বাজেয়াপ্তকরণ এবং ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক সেবাসমূহ পাওয়ার সুযোগ বন্ধ করার জন্য সরকার অনুমোদিত আইন রয়েছে।
২৪শে আগস্ট, গার্নিকা ৩৭ চেম্বারস আইনের কার্যালয় যুক্তরাজ্যের ফরেইন, কমনওয়েলথ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসে গ্লোবাল হিউম্যান রাইটস নিষেধাজ্ঞা আইন ২০২০ এর অধীনে মানবাধিকারের অপব্যবহার এবং দুর্নীতি চর্চার সাথে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের ১৫ জন বর্তমান এবং প্রাক্তন সিনিয়র কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য সুপারিশ করেছে।
২০২০ সালের অক্টোবরে, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটররা একটি দ্বি -পক্ষীয় চিঠি প্রকাশ করে যা র্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিচার বহির্ভূত মৃত্যুদণ্ড, জোরপূর্বক গুম হওয়া এবং নির্যাতনের জন্য গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি হিউম্যান রাইটস অ্যাকাউন্টেবিলিটি এ্যাক্ট [Global Magnitsky Human Rights Accountability Act] এবং ফার্দার কনসলিডেটেড এপ্রপ্রিয়শন্স এ্যাক্ট, ২০২০ [Further Consolidated Appropriations Act, 2020] এর ৭০৩১ (সি) ধারার অধীনে পৃথক পৃথক নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানায়।
জোরপূর্বক গুমের সাথে জড়িত উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মাধ্যমে মামলার দ্রুত সমাধান, জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে অত্যাচার রোধ করা যেতে পারে, দলগুলো বলেছে।
বিশ্বে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে শীর্ষ অবদানকারী দেশ হলো বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুতেরেস- এর উচিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে যোগদানে নিষিদ্ধ করা, মানবাধিকার দলগুলো জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্ট্মেন্টের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরোকে নিশ্চিত করতে হবে যে গ্লোবাল পিস অপারেশন ইনিশিয়েটিভের অধীনে র্যাব সদস্যদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে মোতায়েনের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে ব্যবহার করা হবে না।
“গুরুতর লঙ্ঘনে জড়িত থাকা বাংলাদেশ নিরাপত্তা বাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বিদেশে মোতায়েন করা উচিত নয়,” আর এফ কে (RFK) হিউম্যান রাইটস -এর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি এবং মামলা- মোকদ্দমার ভাইস প্রেসিডেন্ট এঞ্জেলিটা ব্যায়েন্স বলেছেন। “মহাসচিব গুতেরেসের উচিত জাতিসংঘ কর্তৃক মোতায়েন করা ব্যক্তিদের যাচাই-বাছাই বৃদ্ধি করা যাতে করে নিশ্চিত করা যায় যে জাতিসংঘের মানবাধিকার যাচাই- বাছাইয়ের নীতি বাংলাদেশ কর্তৃক সুপারিশ করা ব্যাক্তিদের ওপর কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে।
৩১শে আগস্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল টম ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশনকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক জোরপূর্বক গুম এবং অন্যান্য গুরুতর অত্যাচারের অবসানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে যে সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত সে বিষয়ে ব্রিফ করবে। প্যানেলিস্ট বা অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে থাকবেন একজন বিশিষ্ট বাংলাদেশী [মানবাধিকার] কর্মী ও ফটো সাংবাদিক শহীদুল আলম, গুম হওয়া বিরোধী দলের কর্মী সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম; এবং রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন- এর প্রতিনিধিরা।
“বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যাক্তিদের অনেক পরিবার বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার প্রত্যাখানের মুখোমুখি হয়ে অসহায় বোধ করে, এবং বিশ্বের উচিত পদক্ষেপ নেয়া এবং এ ধরণের অত্যাচার অব্যাহত রাখা বন্ধের জন্যে এবং জবাবদিহিতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গুলির ব্যবহার করা,” এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের যোগাযোগ বিষয়ক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, বলেছেন। “জাতিসংঘের উচিত বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এর সম্পর্কের বিষয়টি আরো বেশি যাচাই-বাছাই করা এবং গুরুতর লঙ্ঘনে জড়িত নেতৃত্বদের জাতিসংঘের পতাকার অধীনে সেবা করার মত সম্মান দেওয়া উচিত নয়।“