Skip to main content

বাংলাদেশঃ সংশোধিত শ্রম আইনে অপূর্ণতা

কিছু উন্নতি হলেও শ্রমিক অধিকার এখনো অবহেলিত

(নিউ ইয়র্ক) - বাংলাদেশের শ্রম আইনে সংশোধন হওয়ায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও শ্রমিক-অধিকার রক্ষায় আইনটিতে ঘাটতি রয়েছে এবং তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অর্জন করতে পারেনি বলে আজ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে। আইনটি আরো সংশোধনের জন্য সরকারকে বাংলাদেশের দাতা ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের চাপ দেয়া উচিত যাতে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করে এবং শ্রমিকরা ইউনিয়ন গঠন, যৌথ দর-কষাকষি ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা সম্পর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে।

অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক চাপে ২০১৩র জুলাই ১৫ বাংলাদেশের শ্রম আইন সংশোধন করে। এপ্রিলে বৃহত্তর ঢাকার রানা প্লাজা ধসে ১,১০০ তৈরিপোশাক শ্রমিকের মৃত্যুতে শ্রম অধিকার আইনে সংশোধনের আওয়াজ ওঠে। রানা প্লাজা ধসের আগে অনেক কারখানায় দুর্ঘটনায় অনেকে প্রাণ হারায়।

“বাংলাদেশ সরকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে সবার দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নিতে। তাই দেরিতে হলেও সরকার যে এখন শ্রমিক অধিকারের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই”, বলেন এশিয়ার ডেপুটি ডাইরেক্টর ফিল রবার্টসন। “এই খবরটি ভালো হতো যদি নতুন আইনটি পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মান ার্জন করতে পারত, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে সরকার ইচ্ছা করেই শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার সীমিত করেছে যখন তারা প্রতিনিয়ত ঝুঁকি ও শোষণের মধ্যে রেখেছে।”

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইসেশনের স্বাধীনতা সম্পর্কিত কনভেনশন ৮৭, সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা ও যৌথ দর-কষাকষি সম্পর্কিত কনভেনশন ৯৮ সহ শ্রম সম্পর্কিত বেশিরভাগ মান বাংলাদেশ অনুমোদন করেছে। যদিও আইনের গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদগুলো সেসব মান অর্জন করতে করেনি।

নতুন সংশোধনগুলো বর্তমান আইনের কিছু সমস্যাপূর্ণ অনুচ্ছেদে হাত দিয়েছে কিন্তু অন্য অনুচ্ছেদ অপরিবর্তিত রেখেছে। যেমনঃ

সরকারিভাবে রেজিস্টশন পেতে কোন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৩০% শ্রমিককে ইউনিয়নে যোগ দিতে হবে, যেখানে অনেক কারখানাও থাকতে পারে। ইউনিয়নগুলো শুধু তাদের কারখানার শ্রমিকদের মধ্য থেকে নেতা নির্বাচন করতে পারবে। এর ফলে মালিকরা ইউনিয়ন বহির্ভূত কারণ দেখিয়ে ইউনিয়ননেতাদের বরখাস্ত করতে পারে, যা সারা বিশ্বেই একটি প্রচলিত রীতি। বাংলাদেশে শ্রমিকদের বড় অংশটি এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে কাজ করে। তাদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার দেয়া হয়নি।

অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টারসহ আরো নতুন কতকগুলো খাতসহ সংশোধিত আইনে লম্বা এক তালিকা করা হয়েছে যেখানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা যাবে না। ধর্মঘট ডাকার ব্যাপারটি এখনও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আবদ্ধ এবং ধর্মঘট ডাকতে দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিকের সমর্থন লাগবে। এর আগে তিন-চতুর্থাংশের সমর্থনের বিধানের চেয়ে এটি সামান্য উন্নত বলে বিবেচিত হতে পারে।

“জনসাধারণের জন্য কষ্টদায়ক” বা “জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থি” ধারা দেখিয়ে সরকার কোন ধর্মঘট নিষিদ্ধ কর দিতে পারে। ধারাগুলো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় সহজেই এর অপব্যবহার হতে পারে।

বিদেশী বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে আইনে ধর্মঘট-বিরোধী বৈষম্যমূলক ধারা রাখা হয়েছে। বিদেশী মালিকানাধীন অথবা বিদেশীদের নিয়ে গঠিত কোন প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠার প্রথম তিন বছরে কোন ধর্মঘট ডাকা যাবে না।

সংশোধিত আইনটি ‘পার্টিসিপেশন কমিটি’ ও ‘সেফটি কমিটি’র উপর সবার মনোযোগ টানার চেষ্টা করছে। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট ও শ্রমিকদের নিয়ে সংগঠিত এই কমিটিগুলোর বাস্তবিক অর্থে বিশেষ কোন ক্ষমতা নেই। ৫০ জনের বেশি শ্রমিক আছে কিন্তু ইউনিয়ন নেই এমন কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করে পার্টিসিপেশন কমিটি ও সেফটি কমিটিতে পাঠাবে। কিন্তু এই কমিটিগুলো আসলে কি দায়িত্ব পালন করবে তা আইনে স্পষ্টভাবে বলা নেই। দুটি কমিটিই প্রকৃত অর্থে এমন দায়িত্বই পালন করছে যা আসলে শ্রমিকদের সংগঠিত ও নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ইউনিয়নের করার কথা ছিল।

“শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করে এমন বিধান বাতিলের সুবর্ণ সুযোগ সরকার পেয়েছিল কিন্তু তা না করে সরকার কিছু নতুন এবং একই সাথে ক্ষতিকর বিধান আইনে ঢুকিয়ে দিয়েছে”, বলেন রবার্টসন। “রানা প্লাজার পরও সরকার শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না।”

সংশোধিত শ্রম আইনে ইউনিয়নের বিদেশী তহবিল নেয়ার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিধান ইউনিয়নের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ইউনিয়ন ও মালিকদের সংগঠনকে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে “প্রয়োগিক, প্রযুক্তিগত, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং আর্থিক সহায়তা” পেতে আইনত শ্রম ও চাকরি কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে আগাম অনুমোদন নিতে হবে।

রবার্টসন বলেন, “বিদেশী আর্থিক সহায়তা আসার উপর নিয়ন্ত্রণ এনে ইউনিয়নকে সহায়তা দানে সরকারের কঠোর নিযন্ত্রণ আরোপ অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। “দাতা দেশগুলোর শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মধ্যে সরকারের এই অন্যায্য হস্তক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত।”

আইনে লিঙ্গ ও প্রতিবন্ধীর প্রতি বৈষম্য দূর করে একই কাজের জন্য সমান মজুরি নিশ্চিত করার বিধান করা হয়েছে। তবে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে তৈরিপোশাক শিল্পের অধিকাংশ নারী শ্রমিক হলেও তাদের যৌন হয়রানি রোধে কোন আইনি পদক্ষেপ নেই। আইনটি সংশোধন করতে গিয়ে সরকার ২০০৯ সালে হাইকোর্টের দেয়া কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি সংক্রান্ত নির্দেশনা আইনে অন্তর্ভুক্ত করার বিরাট সুযোগ হারিয়েছে।

শ্রমিকদের নিরাপত্তা, সংগঠিত হওয়ার অধিকার এবং যৌথ দর-কষাকষি করার অধিকার বাস্তবায়ন করাটাই সরকারের একটি বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পেছনে কারখানার মালিকরা রয়েছে। অনেক সংসদ সদস্যরাই কারখানার মালিক।

২০০৬ সালের আইনের অনেক অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রবিধান সরকার তৈরি করেনি। তাই প্রকৃত অর্থে আইনের নতুন বিধানগুলো বাস্তবায়নের বেলায় তারা আসলে কতটা আগ্রহী তা বলা যাচ্ছে না। যেমন, সরকার পর্যাপ্ত কারখানা পরিদর্শন করেনি। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (আইটিইউসি) জানিয়েছে তারা ধারণা করে যে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে মাত্র ৮০ জন পরিদর্শক ছিল। বাংলাদেশ সরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইন্টারন্যাশনাল লেবার অরগানাইসেশন ২০১২ এর ৮ জুলাই সই করা স্মারকলিপিতে এই সমস্যার কথা স্বীকার করে। সেখানে তারা ২০১৩ সালের মধ্যে আরো ২০০ পরিদর্শক নিয়োগের কথা বলে। দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হিসেবে “ডিপার্টমেন্ট অফ চীফ ইনস্পেক্টর এন্ড এস্ট্যাব্লিশমেন্টসকে একটি ৮০০ পরিদর্শক সম্পন্ন, পর্যাপ্ত বার্ষিক বাজেটের সমর্থনপুষ্ট ও ঠিকমত কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামো নিশ্চিত আছে এমন একটি পূর্ণ ডাইরেক্টোরেটে উন্নতি করার” কথা বলা আছে।

রবার্টসনের মতে, “নতুন শ্রম আইনে যেই ইতিবাচক দিকগুলো রয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সংস্কার যে হয়েছে তা নিশ্চিত করা সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হচ্ছে যে শ্রমিক এবং ইউনিয়নের ক্ষমতায়ন সরকারকে এটি মানতে বাংলাদেশের তৈরিপোশাক ক্রেতা আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর চাপ দেয়া দরকার। রানা প্লাজায় যখন প্রথম ফাটল দেখা যায় তখন যদি শক্তিশালী ইউনিয়ন থাকতো তাহলে কেউই শ্রমিকদের জোর করে পরের দিন কাজে যেতে বাধ্য করতে পারতো না। তাই ভবন যখন ধসে পড়ে তা থেকেও শ্রমিকরা রক্ষা পেতো।” 

Your tax deductible gift can help stop human rights violations and save lives around the world.

Region / Country